বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কাজনক একটি খবর দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশে কক্সবাজারের মহেশপুর উপজেলার মাতারবাড়ীতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এটি চালু হলে পরবর্তী ৩০ বছরে শুধু ওই অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ১৪ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হবে।
বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ খাতে মহাপরিকল্পনার যে খসড়া করেছে, সেখানে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে এ রকম কয়লাভিত্তিক মোট ২৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলেছে। শুধু কয়লা পুড়িয়েই ওই সময়ের মধ্যে সরকার ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। এরই মধ্যে কয়েকটির কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বিশ্ব যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন পরিবেশ দূষণের এই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। কয়লা আমদানি করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে সরকারকে অনেক খেসারত দিতে হতে পারে। ফলে এখনই পরিবেশবান্ধব জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজর দেওয়া উচিত।
গ্রিনপিস সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে আরও বলেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জি-৭ভুক্ত দেশ জাপান বর্তমানে মোট ১৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত জাপান এরই মধ্যে বিনিয়োগ করেছে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলাকালে ৩০ বছরে পরিবেশ দূষণে ওই অঞ্চলে চার লাখ ১০ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে শুধু মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকাকালে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে অকালমৃত্যুর শিকার হবে ১৪ হাজার, ভারতে এক লাখ ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ৭২ হাজার এবং ভিয়েতনামে মারা যাবে ৩৬ হাজার মানুষ।
জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র জাপানই তার দেশে ও বিদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। অন্যরা এ খাতে আর বিনিয়োগ করছে না। আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশ নতুন করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে না। পুরনো বহু কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে শুধু পরিবেশের কথা চিন্তা করে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিষয়টি ক্রমেই স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে জ্বালানিরও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। এখন নানামুখী জ্বালানি আবিস্কৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো কয়লার সমপরিমাণ মূল্যে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি পাওয়া যেতেও পারে। ফলে এখনই কয়লা পুড়িয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা ঠিক হবে না।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে, বাস্তব কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির বহুমুখীকরণ করা হচ্ছে। কারণ, বিশ্বে বিভিন্ন কারণে জ্বালানির দামে আকস্মিক পরিবর্তন আসে। ফলে ভারসাম্য রক্ষার্থে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। ব্যাখ্যা করে সরকারি এই কর্মকর্তা আরও বলেন, অনেকে বলছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রূপপুরে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ চলছে। গ্যাস, ডিজেল, ফার্নেস, কয়লা, পানি, সৌর- সব উপায়েই আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করেছি। এতে বিশ্বে কোনো একটি জ্বালানির দামে ওঠানামা হলেও আমাদের ভারসাম্য রক্ষা হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই কম। ফলে এখন কয়লা দিয়েও উৎপাদন বাড়াতে হবে। পরিবেশের জন্য একটু ক্ষতিকর হলেও বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। ফলে দূষণ কম হবে।
গ্রিনপিস ওই প্রতিবেদনে আরও বলেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জাপান কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ এই অর্থের মধ্যে পাচ্ছে ১৮ ভাগ, ভিয়েতনাম ২০ ও ইন্দোনেশিয়া ৪২ ভাগ। এই বিনিয়োগ জাপান সরকারের। গ্রিনপিস কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রূপান্তরের পরামর্শ দিয়ে আসছে।