নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় ম্যাচ। তাও ভিন দেশের মাটিতে ১১৪ টেস্ট খেলা বাংলাদেশের বিপক্ষে। যেখানে আছেন সাকিব আল হাসানের মতো অলরাউন্ডার। মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদদের মতো অভিজ্ঞ টেস্ট ক্রিকেটার। কিন্তু সেই ম্যাচেই ২২৪ রানের বড় জয় তুলে নিলো তারা! আফগানরা চতুর্থ দিন বিকালেই জয়ের সুবাস পাচ্ছিল। অপেক্ষা ছিল ইতিহাসের! কিন্তু চট্টগ্রামে রাত থেকে বৃষ্টি! ৫ম দিন সকালেও তা ঝরতে থাকে। মাঝে একবার খেলা শুরু হলেও ১৩ বল পরই বন্ধ। এবার ধারণা করা হচ্ছিল হয়তো দুর্ভাগা রশিদ খানের দল ম্যাচটা ড্র হবে। কিন্তু সেই বৃষ্টি থাকার পর বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে সাকিবদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে এলো ১৮ ওভার ও ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে হার বা মান বাঁচানোর। তার জন্য লড়াই করতে হবে শেষ চার উইকেট নিয়ে। কিন্তু অধিনায়ক নিজেই প্রথম বলে আত্মহত্যাই করলেন। এরপর একে একে ফিরে গেলেন মিরাজ, তাইজুল ও সৌম্য। উল্লাসে ফেটে গোটা মাঠে লাফিয়ে বেড়ালেন আফগানরা। অন্যদিকে মাথা নিচু করে মাঠ থেকে বের হয়ে গেলেন দেশের তরুণ ক্রিকেটার নাইম হাসান। লজ্জায় যেন সারা শরীরই ভারি হয় গেছে তার। বৃষ্টি ও বাংলাদেশ কেউ পারেনি আফগানদের জয় ঠেকাতে। নিজে নেতৃত্ব ও ১০ উইবেট নিয়ে ইতিহাস গড়ে দলকে ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছেন রশিদ খান। ম্যাচ সেরাও তাই তিনি। মাত্র তৃতীয় টেস্টেই আফগানদের এটি দ্বিতীয় জয়। ইতিহাসে ২ জয় পেতে ৩ ম্যাচ লেগেছিল কেবল অস্ট্রেলিয়ার।
এমন হার কতটা লজ্জার বাংলাদেশের জন্য? যদিও অধিনায়ক সাকিব একে লজ্জা মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না লজ্জার হার, তবে কষ্টের বলতে পারেন।’ তার আগেই অবশ্য হারের দায়টা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন এমন হার মেনে নেয়া কঠিন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি মেনে নেয়াটা অবশ্যই অনেক কষ্টকর ও হতাশার। দায়িত্ব আসলে আমাকে নিতে হবে। কারণ আমি এসে প্রথম বলেই আউট হয়ে গেছি। তাই আমি বলবো আমি দায়ী। আমি একটু নার্ভাস ছিলাম যে কারণে শটটা খেলে ফেলছি। যদি আমি ভুল না করতাম হাঁ হলে অন্য রকমই হতে পারতো।’ আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। জয়ের জন্য পেতেছিল স্পিন ফাঁদ। কিন্তু সেখানেই ডুবেছে দল। উল্টো বাংলাদেশকে স্পিনেই মরণ কামড় দিয়েছে আফগানিস্তান। বিশেষ করে লেগ স্পিনার ও দল নেতা রশিদ খান। সাকিবও মেনে নিয়েছেন হারের ব্যবধানটা আসলে বিশ্বমানের এই লেগ স্পিনারই গড়ে দিয়েছেন। সাকিব বলেন, ‘হ্যাঁ, রশিদ হয়তো মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নেমেছে। কিন্তু সে অনেক দিন থেকে বিশ্বমানের লেগ স্পিন করছে আন্তুর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে। তার সেই অভিজ্ঞতাটাই তিনি টেস্টে কাজে লাগাতে পেরেছে। সত্যি কথা বলতে সেই ছিল আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।’
আফগান অধিনায়ক গতকাল সকাল থেকে অপেক্ষাতে ছিলেন এমন একটি ঐতিহাসিক মুহুর্তের। যে কারণে বৃষ্টি দেখে বাংলাদেশ মাঠে না এলেও তারা চলে এসেছেন। এক পা-ও নড়েননি মাঠ ছেড়ে। বৃষ্টি থামতে তারা মাঠে নেমে যান। অপেক্ষা করেন কখন উইকেটের কভার সরাবে। দুপুর ১টায় একবার খেলা শুরু করে আম্পায়াররা। কিন্তু ১৩ বল খেলতেই ফের বৃষ্টি। এবার এতটাই মুষল ধারে যে কোনো আশাই ছিল না ম্যাচ মাঠ গড়ানোর। কিন্তু দুপুর ৩টায় সেই বৃষ্টি থামে। ফের দেখা যায় আফগানদের অস্থির পাঁয়চারি। অবশেষে আম্পায়াররা মাঠ পরিদর্শন করে ঘোষণা দেয় ৪টা ২০ মিনিটে খেলা শুরু হবে। খেলতে হবে ১৮.৩ বল।
তখনই ক্রিজে টাইগারদের আশা হয়েছিল সাকিব ও সৌম্য সরকার। আগের দিন অধিনায়ক বলেছিলেন জিততে হলে তাদেরই লড়তে হবে। কিন্তু মাত্র তিনিই কিনা প্রথম বলেই আউট। চায়নাম্যান বোলার জহির খানের শর্ট বলে অহেতুক কাট করতে গেলেন সাকিব। ব্যাটের কানায় লেগে বল কিপারের প্লাভসে। উল্লাসে মাতল আফগানরা। ৫৪ বলে ৪৪ করে দলকে ফেলে গেলেন লজ্জার আরো কাছে। এরপর মিরাজের ওপর ভরসা ছিল। কিন্তু একবার জীবন পেয়েও আউট হলেন। রশিদ খানের বলে এলবিডব্লিউ! কিন্তু তিনি তা ভুল প্রমাণ করতে রিভিউ চাইলেন। কিন্তু বিফল হয়ে ফিরলেন সাজঘরে। এরপর রশিদের আরেক তাইজুলকে আউটের দাবি, আম্পয়ারও আঙুল তুলে দিলেন। কিন্তু স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল তা সঠিক নয়। শেষ রিভিউটি মিরাজ নষ্ট করায় অসহায় ভাবে মাঠ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তাইজুলের উইকেট নিয়ে ইনিংসে ৫ম শিকার ধরলেন রশিদ। প্রথম ইনিংসেও নিয়েছিলেন তিনি ৫ উইকেট। এতেই ঢুকে পড়লেন রেকর্ড বুকে। এরপর ভরসা শুধু সৌম্য, সঙ্গী অফস্পিনার নাঈম হাসান। কিন্তু আফগান অধিনায়ক তাকেও ফিরিয়ে দলকে এনে দিলেন অসাধারণ বিজয়।
এই টেস্টে টসে জিতে শুরু করেছিল আফগানিস্তান। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ৭ স্পিনারের অক্রমণকে পাত্তা না দিয়ে প্রথম ইনিংসে করে ৩৪২ রান। সেঞ্চুরি করে রহমত শাহ। জবাব দিতে নেমে রশিদ-নবীদের সামনে মাত্র ২০৫ রানে গুিিটয়ে যায় দল। ১৩৭ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যান নামে আফগানরা। শুরুতে বিপদে পড়লো ২৬০ রান তুলেই ধামে। লিডের সুবাদে বাংলাদেশকে ছুড়ে দেয় ৩৯৮ রানের লক্ষ্য। যা করতে নতুন ইতিহাসই লেখতে হতো টাইগারদের। কিন্তু ব্যর্থতা আর লজ্জাই সঙ্গী হয়ে থাকলো।