সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা একটা প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ, যদিও এ উদ্যোগ আরও আগে থেকে নেয়া উচিত ছিল। তবে যে কোন ভাল উদ্যোগ সময়ের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। আর এই উদ্যোগকে যে দেশবাসী স্বাগত জানিয়েছে তা বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলালেই বুঝা যায়।
আমাদের দেশে দুর্নীতি হঠাৎ করে এ পর্যায়ে আসেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই বা ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে আমাদের এ ভূখণ্ডে দুর্নীতি সবসময় ছিল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এখন একেবারে নাড়ি ধরে টান দিয়েছে। এর সুচিকিৎসা না হলে নাড়ি পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোর অবস্থায় চলে যাবে এবং এতদিনের সব অর্জন ধূলিষ্মাৎ হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘আমার কম্বল কোথায়’ সে সময়ে হাস্যরসের উদ্রেক করলেও তার কিন্তু একটা গভীর তাৎপর্য ছিল। তা হলো, বঙ্গবন্ধু তখন বুঝতে পেরেছিলেন দেশকে উন্নত করতে হলে এই কম্বল চোরদের তথা দুর্নীতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে, তার কাছের লোকজনই এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যা তার বলার ধরন থেকে বুঝা যায়। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার আগেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। এখন অবশ্য তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতি মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আমার বিশ্বাস তিনি সফলকাম হবেন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এটাও বলেছেন, দুর্নীতির উইপোকা আমাদের উন্নয়ন কুরে কুরে খাচ্ছে (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর, ২০১৯)। এই মহা সত্য কথাটা একটু দেরিতে হলেও এই বক্তব্যে তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে, দুর্নীতির মহারোগ থেকে নিরাময়ের। তবে এই উইপোকারা কিন্তু গুটিকতক অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালানকারী তথাকথিত নেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, এদের বিস্তার সমাজের সবক্ষেত্রে- প্রশাসন, রাজনীতি, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। এর মধ্যে রাজনীতি আর প্রশাসনের দুর্নীতিই মুখ্য। আমি অবশ্য দুর্নীতির তাত্ত্বি¡ক আলোচনায় যাব না। তবে বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রধান দিকগুলো হলো ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি ইত্যাদি। এসবের কিছু প্রশাসনের বেলায় প্রযোজ্য হলেও প্রায় সবগুলোই রাজনীতির বিশেষ করে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের বেলায় প্রযোজ্য। এই তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা অনেকটা পরগাছার মতো, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সে দলের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে, বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, বৈষয়িক উন্নতি হাসিল করে। অর্থাৎ এদের কোন রাজনৈতিক আদর্শ বা দর্শন নেই।
এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক দল বা নেতারাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না, তাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়েই এসব আগাছা মহীরুহে পরিণত হয় এবং এক সময়ে দলের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। মজার ব্যাপার হল এই প্রক্রিয়া চলে আসছে অনেক দিন ধরে, সম্ভবত: বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর থেকে। আমাদের দুই প্রধান দল একই দোষে দুষ্ট। তারা যদি এসব পরগাছাদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের ত্যাগী কর্মীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতো, তাহলে হয়তো এ অবস্থার সৃষ্ট হতো না।
আর প্রশাসনিক দুর্নীতি এতই বিস্তারিত যে এর কোথায় শোধরানো দরকার তা নির্ধারণ করা দুরূহ কাজ। তবে প্রশাসন ব্যবস্থাকে বিরাটভাবে নাড়া দিতে হবে, ঢেলে সাজাতে হবে, জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে এবং এতো বড় মাথাভারি প্রশাসনের আদৌ দরকার আছে কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে।
দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়নের কত অংশ হারাচ্ছি তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এটা যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সাবেক অর্থমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, দুর্নীতির কারণে আমরা ২-৩% প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছি, যদিও টিআইবি’র হিসেবে তা কম পক্ষে ৫% (The Daily Star, 13 July 2015)। আমাদের যেখানে নিয়মিত প্রায় ৭% প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেখানে দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে তা বেড়ে ৯-১০% হতো এবং নিয়মিত ওই পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হলে দেশের অবস্থাই পাল্টে যাবে, যদি সেই প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ জনগণের মধ্যে বিস্তার করা যায়। দুর্নীতির কারণে আমরা যে শুধু প্রবৃদ্ধিই হারাচ্ছি তা নয়, বড় ক্ষতি হচ্ছে যেটা, সেটা হল উন্নয়ন টেকসই হচ্ছে না, কাজ হচ্ছে নিম্নমানের, অল্পদিনের মধ্যেই সেসব কাজের মেরামত করতে হচ্ছে, ফলে দেশের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এটাও বলা হচ্ছে যে, এই অভিযানে ঠিক দুর্নীতির রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমি অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একমত- দুর্নীতির কোন রাঘববোয়াল বা চুনোপুঁটি নেই, দুর্নীতি দুর্নীতিই, সেটা এক টাকা হলে যা কোটি টাকা হলেও তা এবং এখানেই আসছে কুইন্সল্যান্ড থেকে শিক্ষার প্রসঙ্গ।
সম্প্রতি কুইন্সল্যান্ডর ডেপুটি প্রিমিয়ার ব্রিসবেনের এক এলাকায় একটি পুরান বাড়ি কিনেছিলেন, যেখান দিয়ে ভবিষ্যতে ক্রস রিভার রেল লাইন যাবে, যে প্রজেক্টের দায়িত্বে ডেপুটি প্রিমিয়ার নিজে। বিরোধীদল এটাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (conflict of interest) খুঁজে পেলো এবং তার বিরুদ্ধে সংসদে অভিযোগ আনলো যে, এই প্রজেক্টের ফলে ওই এলাকার বাড়ি-ঘরের দাম বেড়ে যাবে, আর ডেপুটি প্রিমিয়ার এ প্রজেক্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ভেতরের খবর জানতেন, সেজন্য ওইখানে বাড়ি কিনেছেন, ভবিষ্যতে লাভবান হওয়ার জন্য। এটা শুধুই অনুভূত বা সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব (perceived conflict of interest)। ওইখানে বাড়ি ঘরের দাম বাড়তেও পারে, নাও বাড়তে পারে। তা ডেপুটি প্রিমিয়ার কি করলেন, উনি ঘোষণা দিলেন ওই বাড়ি বিক্রি করে দেবেন এবং কোন লাভ হলে তা দান করে দেবেন। কথামতো তিনি ওই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন, অবশ্য কোন লাভ ছাড়া, যে দামে কেনা সে দামে বেচা। ব্যাপারটা খুবই সামান্য, যে কোন মূল্যায়নে। তবে এখানে দু’টি বিষয় দেখার আছে, বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের- এক, এটাকে আদৌ দুর্নীতি বলা যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে, এটা শুধুই অনুভূত বা সম্ভাব্য দুর্নীতি (perceived corruption), তারপরও ডেপুটি প্রিমিয়ার এটাকে গুরুত্ব দিয়ে বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। দ্বিতীয় দিকটি হলো বিরোধী দলের ভূমিকা, তারা কিন্তু জ্বালাও পোড়াও করলো না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংসদে অভিযোগ আনলো। এটাকেই বলে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি।
মোদ্দা কথা হলো, দুর্নীতির কোন মাপকাঠি নেই, ছোট হলেও দুর্নীতি, বড় হলেও দুর্নীতি এবং দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। আশার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং এও বলেছেন, এ অভিযানে দলের লোকদেরও ছাড় দেয়া হবে না। তার প্রতিফলন ইতিমধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে, সেটা রাজনীতি, প্রশাসন কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য, যেখানেই হোক। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি হলো মাথা এবং এটাতো আমরা সবাই জানি মাথা ঠিক থাকলে সারা শরীর ঠিক থাকে। সুতরাং রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি দমন করতে পারলে অন্যান্য দুর্নীতিও কমে আসবে এবং দেশের উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হবে।
লেখক: অস্ট্রেলিয়ান সরকারের একজন এক্সিকিউটিভ লেভেলের কৃষি বিজ্ঞানী