সিরিয়ায় সাম্প্রতিক হামলা অভিযানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠেছে তুরস্কের বিরুদ্ধে। মোবাইলফোনে ধারণ করা বেশকিছু ভিডিওতে সিরীয় কুর্দিদের ওপর তুর্কি সমর্থিত বাহিনীর নৃশংসতা প্রকাশ পেয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, মিত্রদের কর্মকা-ের জন্য তুরস্ককে দায়ী করা হতে পারে। এমতাবস্থায় অভিযোগ নিয়ে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তুরস্ক। এ খবর দিয়েছে বিবিসি।
ভিডিওটি স্মার্টফোনে ধারণ করা হয়েছে। ভিডিও ধারনকারী ব্যক্তি নিজেকে ফায়লাক আল-মাজিদ ব্যাটালিয়নের মুজাহিদিন হিসেবে পরিচয় দেন। ভিডিওতে দেখা যায়, দাড়িওয়ালা পুরুষরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলছেন। তাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কুর্দি যোদ্ধাদের মৃতদেহ।
আরো একটু দূরে দেখা যায়, একজন রক্তাক্ত নারীর শরীরে পা দিয়ে চাপ দিচ্ছেন কয়েকজন মানুষ। একজন বলেন, এ একটা পতিতা।
বীভৎস ওই ভিডিও ফুটেজেটি দেখতে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের কোনো ভিডিও মনে হয়। কিন্তু ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিরা আইএস জঙ্গি নয়। তারা সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি নামে পরিচিত সিরিয়া সরকারবিরোধী একটি বিদ্রোহী জোটের যোদ্ধা। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থ দিয়ে থাকে তুরস্ক। ভিডিওটি ধারণ করা হয় ২১শে অক্টোবর, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে। যোদ্ধাদের পায়ের নিচে থাকা ওই রক্তাক্ত নারীর নাম আমরা রেনাস। সম্প্রতি সিরিয়ায় তুর্কি হামলা অভিযানে তাকে হত্যা করা হয়। তিনি কুর্দি মিলিশিয়াদের নারী যোদ্ধাদের বাহিনী উইমেন’স প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজে) এর সদস্য ছিলেন। সিরিয়ায় আইএসকে পরাজিত করতে এই বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গত ৯ অক্টোবর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্ক ও তুরস্কপন্থি বাহিনীগুলো কুর্দি-নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স (এসডিএফ) এর বিরুদ্ধে হামলা অভিযান শুরু করে। এর কয়েকদিন আগেই অঞ্চলটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রা¤প। সেখানে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসডিএফ ও ওয়াইপিজি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। এসডিএফ জানিয়েছে, সম্প্রতি ইদলিবে নিহত আইএস নেতা আবু বকর আল-বাগদাদির অবস্থান স¤পর্কে তারাই যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য দিয়েছিল। তুরস্কের হামলার আগ দিয়ে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে তারা পেছন থেকে ছুরি মারার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
‘কাফের ও ধর্মত্যাগীর দল, আমরা তোদের শিরচ্ছেদ করতে এসেছি’
তুরস্ক সিরিয়ায় হামলা শুরুর কয়েকদিন পর তুরস্কপন্থি বিদ্রোহী দলগুলোর ধারণ করা একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এমন একটি ভিডিওতে, এক যোদ্ধাকে আরবিতে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, কাফের ও ধর্মত্যাগীর দল, আমরা তোদের শিরñেদ করতে এসেছি। অপর এক ভিডিওতে, কালো পোশাক ও মুখোশ পরা এক বিদ্রোহীকে অন্যান্য বিদ্রোহীদের সামনে দিয়ে এক নারীকে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। একজনকে দেখা যায় দৃশ্যটি ভিডিও করতে, আরেকজনকে উচ্চস্বরে ‘শূকর’ বলতে শোনা যায়। অপর এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়: তাকে শিরñেদ করতে নিয়ে যাও। আটক ওই নারীর নাম সিসেক কোবানে। তিনিও একজন ওয়াইপিজে যোদ্ধা।
এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভের জাগান দেয়। কোবানে আটক হওয়ার ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পর তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত টিভি চ্যানেলে দেখানো হয় যে, কোবানেকে একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে প্রকাশিত ভিডিওগুলোয় যুদ্ধাপরাধের নমুনা ধরা পড়েছে।
সিরিয়ায় নিযুক্ত বিশেষ মার্কিন দূত জেমস জেফরি বলেন, তুর্কি সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহী বাহিনীদের ভয়ে বহু মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরা বলবো যে, তুরস্কের নির্দেশনায় কাজ করা এসব বিদ্রোহীরা অন্তত একটি ঘটনায় হলেও যুদ্ধাপরাধ করেছে।
৪০ হাজার আইএস জঙ্গি পার হয়েছে তুরস্ক সীমান্ত ব্যবহার করে
জিহাদিদের ছাড় দেয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েছে তুরস্কের বিরুদ্ধে।আইএস বিরোধী জোটের জন্য নিযুক্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাবেক বিশেষ দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক বলেন, আমি আইএস বিরোধী অভিযান চালিয়েছি। ১১০টি দেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বিদেশি যোদ্ধা, জিহাদী তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় এসেছিল। ম্যাকগার্ক জানান, আইএসের আগমন ঠেকাতে তুরস্কের সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। তবে তুরস্ক সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু কুর্দিরা তাদের সীমান্তের নিকটে যাওয়ার সাথেসাথে সেখানে দেয়াল নির্মাণ করে তারে।
তুরস্কের কাছে সিরিয়ায় সাম্প্রতিক হামলায় বিদ্রোহীদের যুদ্ধাপরাধের ব্যাখ্যা চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালিন জানান, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত করবে তারা। কিন্তু কুর্দিশ অধিকারকর্মীরা তুর্কি সরকারের তদন্তে আস্থা রাখছেন না।
চোখে কালো পট্টি বাঁধা ইউরোপের
তুর্কি সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত বিদ্রোহীদের নৃশংসতার ঘটনা নতুন নয়। পূর্বেও এমন ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। তুরস্কের ভেতরে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমতপোষণকারী কুর্দিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক ভিডিওতে, সন্দেহভাজন এক তুর্কি সেনাকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) এর সদস্যদের শিরñেদ করতে দেখা যায়। এখানে উল্লেখ্য, তুরস্ক পিকেকে দলটিকে জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। সেদেশে দলটি নিষিদ্ধ।
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, দুই নারী পিকেকে যোদ্ধাকে একটি পাহাড়ের চূড়ায় পেছন দিকে হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর তুর্কি সেনারা তাদের ওই অবস্থায় গুলি করে ও লাথি দিয়ে চূড়া থেকে ফেলে দেয়। ২০১৫ সালের এক ভিডিওতে দেখা যায়, তুরস্কের কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর সিরনাকের রাস্তায় ২৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃতদেহ গলায় দড়ি বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীরা। ওই ব্যক্তির নাম হাকি লোকমান। ভিডিওটির কিছু অংশ একটি পুলিশ ভ্যানের ভেতরেও ধারণ করা হয়েছিল। কর্মকর্তারা জানায়, তারা আশঙ্কা করেছিল যে, লোকমানের লাশে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল।
কুর্দি অধিকারকর্মীরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এসব নৃশংসতা অগ্রাহ্য করার অভিযোগ এনেছে। সাসেক্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক স¤পর্ক বিষয় সিনিয়র লেকচারার কামারান মাতিন জানান, তুরস্কের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে চোখে কালো কাপড় বেঁধে রেখেছে ইইউ। কারণ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। এছাড়া তাদের অর্থনৈতিক স¤পর্ক ও ইউরোপে বাসকারী লাখো তুর্কির সমালোচনার ভয়ে তারা তা দেখেও না দেখার ভান করে।
তিনি বলেন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউরোপীয় দেশগুলোকে চুপ রাখার নতুন অস্ত্র হাতে পায় তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান একাধিকবার সিরীয় শরণার্থী দিয়ে ইউরোপ ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। তাতে বেশ কাজ হয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো তুরস্কের সমালোচনা করতে চায় না, তার মূল্য যাইহোক না কেন।