২০১৬ সালের ১লা জুলাই রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। পরদিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ থেকে জিম্মিদের মুক্ত করা হয়। ঘটনাস্থলে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। এছাড়া দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ও বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন ৩৬ জন। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি মামলা করে। প্রায় দুই বছর তদন্ত শেষে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তাদের মধ্যে আটজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিটিটিসি।
বাকি আসামিরা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়। আজ বুধবার এই মামলার রায় দেয়া হবে।
এজাহারে উল্লেখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ
এই মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাস গুলশান থানার ৭১ নং রোড থেকে ৯২ নং রোড এবং আশপাশ এলাকায় সকাল ৯টা থেকে পেট্রোল ডিউটি করছিলেন। তিনি রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন, ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে গোলাগুলি হচ্ছে। সংবাদ পাওয়ার পর তিনি ফোর্সসহ রাত ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে রেস্টুরেন্টের কাছে গিয়ে দেখতে পান, ভেতরে কিছু সন্ত্রাসী ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করছে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের ওপরও বোমা নিক্ষেপ ও এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে এসআই ফারুক হোসেন ও তার সঙ্গে থাকা কনস্টেবল প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন গুরুতর আহত হন। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ডিএমপির সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও ফোর্স ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা বেকারির চারপাশ ঘিরে রেখে সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। তখন সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে অনবরত গ্রেনেড ও গুলি করতে থাকে। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা বেকারির পশ্চিম দিকের ৭৯ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে অবস্থানরত পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি শুরু করে। এ সময় ৩০-৩৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও ফোর্স আহত হন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাদের সবাইকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ২০ মিনিটে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান মারা যান। এর কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মো. রবিউল করিমও মারা যান।
সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন অভিযান চালায়। সে সময় সন্ত্রাসীরা কমান্ডো বাহিনীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি করে। এ অভিযানে পাঁচ জঙ্গি এবং ওই বেকারির এক কর্মীসহ ছয়জন নিহত হয়। পাঁচ জঙ্গি হলো–মীর মোবাশ্বের (১৯), রোহান ইমতিয়াজ (২০), নিবরাস ইসলাম (২০), মো. খায়রুল ইসলাম পায়েল (২২), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ (২৬)। নিহত বেকারির কর্মীর নাম সাইফুল চৌকিদার। এ সময় প্যারা কমান্ডোরা দেশি-বিদেশি জিম্মিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
এছাড়া, নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি এবং একজন ভারতীয় ও তিনজন বাংলাদেশি (তাদের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক) নাগরিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে ছয় সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিহতদের মৃতদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) পাঠানো হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সিআইডি ক্রাইম সিন বিভাগের সহায়তায় গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস, এসআই মফিদুল ইসলাম, এসআই জয়নাল আবেদীন এবং এসআই হুমায়ুন কবির ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্যসহ অন্যান্য জিনিস এবং ভিকটিমদের ব্যক্তিগত মালামাল জব্দ করে হেফাজতে নেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ৮ জনের পরিচয়
১. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ ওরফে শান্ত ওরফে টাইগার ওরফে আদিল ওরফে জাহিদ (৩২), বাবা মৃত মাওলানা ওসমান গনি ম-ল, মা মোছা. রাহেলা বেগম, সাং–পশ্চিম রাঘবপুর (ভুতমারা ঘাট), থানা গোবিন্দগঞ্জ, জেলা গাইবান্ধা। গ্রেপ্তার টাঙ্গাইল থেকে।
২. মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান (৬০), বাবামৃত হোসেন আলী, সাং হাজারবিঘি চানপুর, থানা শিবগঞ্জ, জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার ।
৩. রাফিউল ইসলাম ওরফে রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান (২২), বাবামো. রেজাউল হক, মা রোকেয়া আক্তার, সাং ইসলামপুর জামিলনগর, থানাবগুড়া সদর, জেলা বগুড়া। কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার ।
৪. মো. আব্দুস সবুর খান ওরফে হাসান ওরফে হাতকাটা সোহেল মাহফুজ ওরফে মুসাফির ওরফে জয় ওরফে নসুরুল্লাহ (৩৩), বাবা রেজাউল করিম শেখ, মা মনোয়ারা বেগম, সাংসাদিপুর (কাবলিপাড়া), পোস্ট শিলাইদহ, থানা কুমারখালী, জেলা কুষ্টিয়া। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার ।
৫. হাদিসুর রহমান সাগর, বাবাহারুন রশিদ, মামোছা. আসিয়া বেগম, সাং কয়রাপাড়া কাদোয়া, থানা জয়পুরহাট, জেলা জয়পুরহাট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার ।
৬. মো. আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ (২০), বাবামো. আব্দুস সালাম, মামোছা. নাসিমা বেগম, সাং সাবাইহাট কাঞ্চনপুর, থানামান্দা, জেলা নওগাঁ; বর্তমান ঠিকানা: মথুরান ওহাটা, থানাপবা, জেলা রাজশাহী। নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার ।
৭. শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ (২৫), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, বাবা আবদুল হাকিম, গ্রাম শ্রীপুর, থানা বাগমারা, জেলা রাজশাহী।
৮. মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন (৩০), বাবা মৃত নাসির উদ্দিন সরদার, মাকোহিনুর বেগম, সাংশেকেরমারিয়া, পোস্ট ভাটারা, থাননন্দীগ্রাম, জেলা বগুড়া।
ঘটনার সময় নিহত জঙ্গিরা
১. রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, বাবা এম এম ইমতিয়াজ খান বাবুল, মা জেরিন ইমতিয়াজ, সাং ব্লক-বি, প্লট-৭/৯ লালমাটিয়া, ঢাকা।
২. মীর মোবাশ্বের (১৭), বাবা মীর হায়াৎ কবির, মা খালেদা পারভীন, সাং বাসা নং ৬৮/এ, রোড ৫, পুরাতন বনানী ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা।
৩. নিবরাস ইসলাম (২৪), বাবা নজরুল ইসলাম, মা লাইলা ইসলাম রিতা, সাং বাড়ি ৫, রোড ১৬, সেক্টর ৩, উত্তরা, ঢাকা।
৪. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ (২৬), বাবা বদিউজ্জামান বদি, মা আসিয়া খাতুন, সাং চিথুলিয়া কৈয়াগাড়ী, থানা ধুনট, জেলা বগুড়া।
৫. খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল (২২), বাবা আবুল হোসেন, মা পিয়ারা বেগম, সাং শ্রী কুষ্টিয়া, থানা শাহজাহানপুর, জেলা বগুড়া।
বিভিন্ন সময় অভিযানে নিহত:
১. তামিম চৌধুরী, বাবা শফিকুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে সফি আহমেদ চৌধুরী, সাং সোয়াসং বড়গ্রাম, চৌধুরীপাড়া বিজিবি ক্যাম্পের পাশে, থানা বিয়ানীবাজার, জেলা সিলেট। বর্তমান ঠিকানা পাইকপাড়া শাহসুজা, রোড নুরুদ্দিন দেয়ানের বাড়ি, বাড়ি নং ৪১০/১, থানা নারায়ণগঞ্জ সদর, জেলা নারায়ণগঞ্জ।
২. সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান, বাবা–আব্দুল মান্নান, সাং–চামার মুরশী, থানা–ভোলাহাট, জেলা–চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
৩. তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ ওরফে আবদুল করিম, বাবা–বাতেন কাদেরী, সাং–পশ্চিম বাটিকমারী, ৯ নং ওয়ার্ড, প্রফেসর কলোনি, থানা–গাইবান্ধা, জেলা–গাইবান্ধা। বর্তমান ঠিকানা–২০৯/৫ লালবাগ রোড, জনৈক হাজী কায়সারের পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলা।
৪. নুরুল ইসলাম মারজান, বাবা–নিজাম উদ্দিন, সাং আফুরি পূর্ব পাড়া (হেমায়েতপুর), থানা পাবনা সদর, জেলা পাবনা।
৫. বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট, বাবা সিরাজ মাস্টার, সাং মাস্টার বাড়ি, থানা তানোর, জেলা রাজশাহী।
৬. মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান (২০), বাবা আয়নাল হক, সাং শাহাবাজপুর থানা, থানা–শিবগঞ্জ, জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
৭. মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে জাহিদ ওরফে মেজর মুরাদ, বাবা নূরুল ইসলাম, সাং পশ্চিম চাঁদপুর, ইউনিয়ন পরিষদ নং ৫ পাঁচতুরি, থানা কোতোয়ালি, জেলা কুমিল্লা।
৮. রায়হান ওরফে রায়হানুল কবির ওরফে ফারুক ওরফে তারেক (২০), বাবা শাহজাহান, মা রাহেলা খাতুন, সাং পশুয়া (টাঙ্গাইল পাড়া), থানা পীরগাছা, জেলা রংপুর।