মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে যাওয়া বা কোনো কারণে অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের বিপদ পায়ে পায়ে। তাদের দেশে ফিরতে হচ্ছে, সেখানে বৈধতা পাওয়ার কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তাতেও বিপত্তি! দালালদের হয়রানি, সিন্ডিকেটের ‘বাণিজ্যে’ নাজেহাল নিরীহ বাংলাদেশিরা। ট্রাভেল পাস জাল করা এমনকি কিডন্যাপ এর মতো গুরুতর ঘটনাও ঘটাচ্ছে দালাল চক্র। এরই মধ্যে দালালের কারসাজিতে দেশে ফিরতে গিয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে অন্তত ২০ জন বাংলাদেশিকে। কুয়ালালামপুরে ইমিগ্রেশন তাদের আটকে দেয়। জালিয়াতির দায় পড়েছে আটক ভূক্তভোগীদের ওপর। আদালত তাদের জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।
দূতাবাসে কাঙ্খিত সেবা ও সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ- সে তো অনেক পুরনো। যারা এতো বাধা পেরিয়ে দেশে ফেরার প্রকৃত ডকুমেন্ট হাতে পেয়েছেন তাদের ওপর খাঁড়ার ঘা বা নতুন বিপদ হচ্ছে বিমান টিকেট।
একমাত্র সরকারী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কুয়ালালামপুর টু ঢাকা টিকেট যেখানে আট থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে সারা বছর, এখন সেই টিকেটের মূল্য চল্লিশ হাজারের কোটায়। সেটাও সোনার হরিণ। একটি সূত্রের দাবি, ডিসেম্বরে শেষ দিনগুলোতে বিমানের ঢাকা ফেরার কোন টিকেটই গতকাল থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল বিমানই নয়, বাংলাদেশের বেসরকারী অন্য বিমান সংস্থাগুলো যাদের কুয়ালালামপুর রুটে নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে তাদেরও ডিসেম্বরের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ টিকেট অ্যাডভান্স বিক্রি হয়ে গেছে। একটি বিমান সংস্থা কুয়ালালামপুর রুটে শিডিউলের অতিরিক্ত ৩টি (বাড়তি) ফ্লাইট যুক্ত করেছে দেশটি ভ্রমণেচ্ছু ঢাকাইয়া পর্যটকদের জন্য। সরকারী-বেসরকারী বিমান সংস্থার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা অবশ্য বলছেন- ডিসেম্বরে এমনিতেই পূর্বের দেশগুলোতে ভ্রমণেচ্ছুদের চাপ বেড়ে যায়।
সেখানে মালয়েশিয়া ঘোষিত বিদেশীদের দেশে ফেরা কর্মসূচি হয়ত চাপটাতে মাত্রা যুক্ত করেছে। কুয়ালামপুর মিশন এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, অবৈধ বিদেশীদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকার নির্ধারিত দেশে ফেরা কর্মসূচী ‘ব্যাক ফর গুড’-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে চলতি বছরের ১লা আগস্ট থেকে। এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩১ শে ডিসেম্বর। প্রায় ৩৪ হাজার বাংলাদেশি ওই সুযোগ নেয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। পাসপোর্টবিহীন ওই বাংলাদেশিদের জন্য দূতাবাস ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করছে। মালয়েশিয়ান সরকার নির্ধারিত ৭০০ রিঙ্গিত জরিমানা দিয়ে তাদের বিনা বাধায় দেশে ফেরার কথা। অনেকে সুযোগটি নিচ্ছে দেরিতে। ফলে ফ্লাইটের ওপর চাপ পড়ছে। টিকেটের বাড়তি মূল্য, সিন্ডিকেট, জাল জালিয়াতি কিংবা দূতাবাসের সেবা প্রাপ্তিতে অসুবিধার বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কোন প্রতিনিধিই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিতে রাজী হননি।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা : এদিকে অনানুষ্ঠানিক একটি সূত্র মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশিদের দেশে ফেরা সংক্রান্ত জটিলতার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির সূযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফেরা নেপাল, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার অবৈধদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কী আয়োজন চলছে। সেখানে বাংলাদেশিদের অবস্থা কতটা শোচনীয় সেটি তুলে ধরা হয়েছে। ওই পর্যালোচনাটির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশগুলো তার নাগরিকদের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ দূতাবাসও যতটা সম্ভব সেবা ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ওই বিশ্লেষণে মোটা দাগে যে ৩টি দেশের চিত্র ওঠে এসেছে তার অন্যতম ইন্দোনেশিয়া। দাবি করা হয়েছে- ইন্দোনিয়ার দূতাবাস তাদের বিপুল সংখ্যক অবৈধ নাগরিকদের দেশে ফেরাতে মধ্যরাত অবধি খোলা রাখছে। কর্মকর্তারা রাত ১-২টা পর্যন্ত কাজ করছেন তাদের নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ইস্যু করতে।
দেশটির বিমানগুলো নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২৫-৩৫ শতাংশ কমে ওই কর্মসূচির আওতায় ঘরে ফেরা নাগরিকদের টিকেট দিচ্ছে। নেপাল তার অবৈধ নাগরিকদের নির্বিঘ্ন ঘরে ফেরা নিশ্চিতে টিকেট মূল্য ৩০ ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। ফিলিপাইন আরও এক ধাপ এগিয়ে তার ন্যাশনাল ক্যারিয়ারের টিকেট মূল্য ৪০ ভাগ কমিয়ে দিয়েছে ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির আওতায় দেশে ফেরা নাগরিকদের জন্য। তুলনামূলক সেই পর্যালোচনায় বাংলাদেশিদের করুণ অবস্থার আশঙ্কা করা হয়েছে। বিশেষ করে শেষ সময়ে ঢাকাগামী ফ্লাইট পেতে তাদের যারপর নাই ভোগান্তির আশঙ্কা ব্যক্ত করে এ বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি এবং তড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। জানানো হয়েছে- পরিস্থিতি এমন যে ঢাকায় ফেরা একটি টিকেটের জন্য ৫৬ হাজার টাকাও গুনতে হতে পারে বাংলাদেশিদের। হিথ্রো হয়ে দেশে ফিরলে যে অর্থ ব্যয় হতো এটি তার চেয়েও বেশি।