এখনো হাসপাতালে আসছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। মওসুম শেষ হলেও বন্ধ হচ্ছে না রোগী আসা। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মশক নিধন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়া এবং গত বছর ডেঙ্গুর ব্যাপক বংশ বিস্তারের কারণে এখনও এর রেশ রয়ে গেছে। শীত শেষ হয়ে আসায় সামনে এর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। গত বছরের মার্চের শেষের দিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও চলতি বছরে ইতিমধ্যেই আক্রান্তের সংখ্যা ২১৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে রোববার পর্যন্ত সারাদেশে ২২১ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ২১০ জন চিকিৎসার পর হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।
বর্তমানে ১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রাজধানীর ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঢাকায় ৭ জন আর দেশের অন্যান্য এলাকায় ৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে এ সময়কালে ডেঙ্গু আক্রান্ত কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এবছর শুধু জানুয়ারিতে ১৯৯ জন ও ফেব্রুয়ারির এ পর্যন্ত ২২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। গত বছর মার্চে রাজধানীতে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পরবর্তী সময়ে তা রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আগস্ট মাসে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। সারা দেশে এই এক মাসেই প্রায় ৫৩ হাজার রোগী ভর্তির রেকর্ড হয়, যার অধিকাংশই ছিল রাজধানীতে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সে সময় নানা পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সরকারি হিসেবেই মারা যান ১৬৬ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী ভর্তি হয়। এতে উপায়ান্তর না পেয়ে হাসপাতালের মেঝে, বারান্দায় বা ফাঁকা স্থানগুলোতেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য শয্যা পাতা হয়। সে সময় ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ছাড়াও ছিল আক্রান্তদের ওষুধের সংকট। বেশ কয়েক মাস ধরে এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পর ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমে আসে। গত নভেম্বরের শেষদিকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অনেকটাই কমে এলে থমকে যায় সরকারি সব উদ্যোগ। একপর্যায়ে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চাপা পড়ে যায় ডেঙ্গুজ্বরের বিষয়টি। এর সঙ্গে সঙ্গে মশক নিধন কার্যক্রমও কমতে কমতে একপর্যায়ে থেমে যায়। এ অবস্থায় কিছুদিন ধরে রাজধানীতে ফের বাড়তে শুরু করেছে মশার উপদ্রব। তাই গতবছরের মতো এবারও একই সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই করোনা ভাইরাসের মতো প্রাণঘাতি মহামারী নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন রাজধানীবাসী। বলা হচ্ছে, ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস প্রবেশ করলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। করোনার এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশার প্রাদুর্ভাব। নগরবিদদের মতে, রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় এখনো এডিস মশার বিস্তার রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার জরিপেও রাজধানীর অন্তত ত্রিশটি স্থানে মশার ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছিল। সেসব স্থানে এখনো এডিস মশার লার্ভা রয়ে গেছে। সেইসঙ্গে কিউলেক্স মশারও ব্যাপক বিস্তার রয়েছে। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রাজধানীবাসী।
সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, গতবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় নিয়মিতই মশা নিধন ওষুধ ছিটানো হতো। কিন্তু গত দুই তিনমাস ধরে তা বন্ধ আছে। আর চলছে না মশার প্রজনন রোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানও। ফলে এরই মধ্যে মশার উৎপাত ফের বাড়তে শুরু করেছে। রায়ের বাজার, জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, বসিলা, মিরপুর, আজিমপুর, কামরাঙ্গীচর, লালবাগ, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মগবাজার, রামপুরা, বনশ্রীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকার অবস্থা খুবই নাজুক। মশক নিধনে এসব এলকায় সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রম নেই। সংস্কারের উদ্দেশ্যে যেসব ড্রেন খুড়ে রাখা হয়েছে তা মাসের পর মাস সেভাবেই পড়ে আছে। আবার কোন কোন এলাকায় ড্রেনেজ লাইন ময়লা আবর্জনা আটকে দীর্ঘদিন ধরে জ্যাম হয়ে পড়ে আছে। ড্রেনেজ লাইনের পঁচা পানি থেকে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে মশার উপদ্রব প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেছে।
রাজধানীর বসিলা এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, ড্রেনের সংস্কার কাজ শেষ না করায় ময়লা আবর্জনা ও পঁচা পানির দুর্গন্ধে এলাকায় থাকা দায়। আশপাশের পরিবেশ নোংরা হওয়ায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার যন্ত্রণায় এলাকায় বসবাস কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা হলে কোথাও স্থির থাকা যায় না। দামি মশার কয়েল দিয়েও ঘর থেকে মশা তারানো যায় না। সারাদিন ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। শীতকালেই যে অবস্থা তাতে গরমকাল আসলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে গতবারের মত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রায়ের বাজারের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, গত তিন চার মাস হলো আমাদের এলাকায় কখনই মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। মশার যন্ত্রণা দিন দিন বাড়লেও সিটি করপোরেশনের কোনো মশক নিধন কর্মীকে চোখে পড়েনি। জিগাতলার বাসিন্দা আমানুল্লাহ বলেন, মশার জ্বালায় ঘুমানো কষ্টকর। দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, আমরা গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এখন জানি কোথায় এডিস মশার বংশবিস্তার, কোথায় ঘনত্ব বেশি, কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগিয়ে আমরা বছরের শুরু থেকেই পুরোদমে কাজে নেমেছি। উত্তর সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও উর্ধ্বতন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ডা. মো. ইমদাদুল হক বলেন, আমাদের কার্যক্রম এখনো চলছে তবে এই মাসের শেষের দিক থেকে আমাদের কার্যক্রম রাজধানীর সব এলাকায় শুরু হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।