‘হাশরের দিন বলিবেন খোদা-হে আদম সন্তান/তুমি মোরে সেবা করো নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান/মানুষ বলিবে-তুমি প্রভু করতার/আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?/বলিবেন খোদা-দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে/তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে’ । বাল্যকালে পঠিত আব্দুল কাদির বিরচিত ‘মানুষের সেবা’ কবিতাটি ভাল লাগে নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর । এই কবিতাটির কথাগুলোর মূলমন্ত্রে দিক্ষীত হয়ে ছোট্ট একটি শিশু জীবনে পথচলার প্রারম্ভেই তার লক্ষ স্থির করে ফেলে, যেভাবেই হোক তাকে মানুষের সেবক হতে হবে । যদিও আব্দুল কাদির তার এ কবিতাটি আমাদের ডাক্তারদের জন্য লিখেছেন কিনা কিংবা ডাক্তারদের সেবার কাছে এ কবিতাটির কতটুকু মূল্য আছে তা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে । কেননা ‘মানুষের সেবা’ কবিতায় যে ধরনের সেবার কথা বলা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা ডাক্তাররা রোগীদেরকে করে থাকেন । একজন ডাক্তার প্রত্যুষে ঘুম ভাঙার পর থেকে দীর্ঘ একটি ক্লান্তিকর দিন পার করে রাত্রে ঘুমুতে যাওয়ার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে রোগীর সেবার নিয়োজিত থাকেন । এমনকি রাতের সামন্য যে সময়টুকু বিশ্রামের জন্য পান সে সময়টাতেও রোগীর আত্মীয় স্বজন কর্তৃক বিজ্ঞানের নব আবিস্কার মোবাইল কিংবা টেলিফোনের রিং বারবার ডাক্তার সাহেবদের ঘুম ভেঙে ফেলে । তবুও ডাক্তারদেরকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায় না । অন্য পেশার কোন মানুষের সাথে এ ধরনের বিরক্তিকর আচরণ করলে যেখানে নিশ্চিত লাঠি নিয়ে ঠেঙাতে আসত সেখানে ডাক্তাররা পরম মমতায় রোগীকে কিংবা রোগীর আত্মীয় স্বজনকে দিক নির্দেশনা দিয়ে চলেন । ডাক্তারদেরকে শুধু চিকিৎসা পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয় না বরং কিভাবে একজন মানুষের সাথে শিষ্টাচার প্রদর্শন করা যায়, ধৈর্য্যরে সর্বোত্তম পরীক্ষা দেয়া যায় তার সবটাই শিক্ষা দেয়া হয় । এজন্যই দেশের গর্বের সন্তান ডাক্তাররা আজও তাদের মহান পেশাকে চরম মমতায় আগলে রেখে দেশের মানুষের শারীরীক এবং মানসিক কষ্ট দূর করার জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ।
সৃষ্টিগতভাবেই স্রষ্টা মানুষকে সমান ধৈর্য্য দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। কাউকে চরমভাবে ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা দিয়েছেন আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক কথাবার্তায় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন । তবে ডাক্তারদের মধ্যের অনেকেই চরমভাবে ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিতে পরামঙ্গম । কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে ব্যতিক্রম ঘটে না তা কিন্তু নয় । ডাক্তাররাও তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের কারনে মাঝে মাঝে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন । অতীতে ডাক্তারদের ধৈর্য্য হারানোর সংখ্যাটা হাতে গোনা থাকলেও বর্তমানে এ সংখ্যাটা হু হু করে বেড়ে চলছে । যার কারনে দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে রোগীর সাথে ডাক্তারদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে । গত কয়েকমাসে বাংলাদেশের কয়েকটি নামকরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কয়েকবার ডাক্তারদের ধর্মঘট কিংবা কর্মবিরতি পালন করতে দেখা গেছে (সবচেয়ে আশ্চার্যের হলেও সত্য যে, ডাক্তাররা সরকারী হাসপাতালে তাদরে কর্মবিরতি পালন করলেও কোন প্রাইভেট ক্লিনিকে কিংবা ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ধর্মঘট কিংবা কর্মবিরতি পালন করতে শোনা যায় নি) । একটি হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা জরুরী বিভাগের মত একটি অংশেও তালা ঝুলিয়ে চিকিৎসা সেবাকে স্থবির করে দেয়া হয়েছে । তবে কার্যক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে বর্তমানের পেশাদার ডাক্তারদের চেয়েও ইন্টার্নী কিংবা শিক্ষানবীষ আগামী দিনের ডাক্তাররাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে । যারা আগামী দিনের চিকিৎসা ক্ষেত্রের নেতৃত্ব দিবে তারা আজ কেন এমন খেলায় মেতে উঠল সেটা ক্ষতিয়ে দেখার বিষয় । ইন্টার্নী ডাক্তারদের দু’চারজন যেখানেই যে সমস্যার আক্রান্ত হোক তার প্রভাব পড়ছে রোগীদের উপর । ইন্টার্নী ডাক্তারদের মধ্যে ঐক্য থাকা অপরীহার্য । কিন্তু সেই ঐক্যের সুযোগ নিয়ে একটি অন্যায় কর্মের দ্বারা হাজার হাজার রোগীকে মৃত্যুর মূখে ঠেলে দিবে এ অনৈতিক অধিকার সম্ভবত ভবিষ্যতের ভাবী ডাক্তারদের নেই ।
দিনের পর দিন ডাক্তারদের ধর্মঘট এবং চিকিৎসা ক্ষেত্র থেকে ফিরে থাকায় দেশের সাধারণ রোগীরা যেমন বিপদগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি দেশের সরকারও বিব্রত হয়ে এর একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজছে । ইন্টার্নী ডাক্তাররা যদি তাদের সকল কর্মের দায়ভার রোগীর উপর চাপিয়ে দেয় তবে প্রশ্ন জাগে রোগী হওয়াটাই কি দোষের নাকি পাপের ? পত্রিকায় দেখলাম, রাজধানীর চাঁনখারপুলে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের হাতে মার খেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেক (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছে ইন্টার্নী ডাক্তাররা। শনিবার রাত ৯টার সময় একজন চিকিৎসকসহ ৫জন ইন্টার্নী চিকিৎসককে পুরান ঢাকার চাঁনখারপুলে অজ্ঞাতরা হামলা চালিয়েছে । ঢামেক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দেড়শতাধিক ইন্টার্নী চিকিৎসক শনিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১ট পর্যন্ত প্রথমে জরুরী বিভাগে তালা এবং পরে মেইন গেটে তালা মেরে সহকর্মীদের মারধর করার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন । রাত পৌনে একটার দিকে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোস্তাফিজুর রহমানের হস্তক্ষেপে মেইন গেটের তালা খুলে জরুরী বিভাগের চিকিৎসা সেবা চালু হয় । তবে রবিবার সকাল থেকে জরুরী বিভাগের সেবা আবারও বন্ধ করে দিয়েছে ইন্টার্নী চিকিৎসকরা । (এ লেখা পর্যন্ত জরুরী বিভাগ বন্ধ ছিল) । ইন্টার্নী চিকিৎসকদের শরীরে যে সকল অজ্ঞাতরা হাত দিয়েছে তাদের বিচার অবশ্যই বাংলাদেশের প্রশাসন করবে । তবে এজন্য প্রশাসকদের সময় দেয়া জরুরী। দেশের অন্যান্য ঘটনার মত চিকিৎকদের উপর হামলাকারীদেরকেও চিহ্নিত করে সরকার তাদেরকে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির মূখোমূখি করবে তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নাই । কিন্তু চিকিৎসক এবং ইন্টার্নীদের উপর হামলার দায়ভার কেন রোগীকে বহন করতে হবে ?
একজন মানুষের সন্তান জন্ম গ্রহন করার সাথে সাথেই সে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন, সন্তানকে ডাক্তার বানাতে হবে । সন্তান ডাক্তার হয়ে আর্তমানবতার সেবা করবে । সে অনুযায়ী তার সন্তানকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে । সন্তানও যখন তার অভিভাবকদের অভিপ্রায় বুঝতে পারে তখন সেও ডাক্তার হওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তার সাধনা চালাতে থাকে । একজন সাধারন ছাত্রের চেয়ে একজন ডাক্তার ছাত্রের মর্যাদা শুধু কাগজ কলমেই বেশি নয় বরং সামাজিক স্বীকৃতি, মেধার স্বীকৃতিতেও অনেক বেশি । অন্য বিষয়ের একজন ছাত্রের চেয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন ছাত্রকে পরিশ্রমও বেশি করতে হয় । তাইতো পেশার জগতে ডাক্তারী পেশার সাথে অন্য কোন পেশার তুলনা চলে না । সেই ডাক্তারাই যদি এমন উদ্ভট কার্যকলাপ করে তবে পেশার এ মর্যাদা কত দিন সমুন্নত থাকবে ডাক্তারদের সেটা ভেবে দেখা উচিত । সেদিন কোন একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে একজন ডাক্তার সাহেবের একটি নিবন্ধ পড়েছিলাম । যার শিরোনাম ছিল “ডাক্তার হব নাকি মানুষ হব” । হিন্দু ভদ্রলোক চমৎকার ভাবে ডাক্তারী পেশার সাথে মনুষ্যত্বকে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন । তার লেখাটি পড়ে আভিভূত হয়ে গিয়েছিল । বিনম্্র শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম ডাক্তারি পেশাকে । সে লেখাটিতে ভদ্রলোক প্রমান করেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’ । আগামীর ডাক্তারদের এ চিরসত্য বানীটিকে ভূলে গেলে চলবে না ।
শুধু শিক্ষকের জন্য নয় বরং ডাক্তারদের জন্যও মনে রাখতে হবে তারা মানুষের পরমাত্বীয় এবং ধরনীর দিক্ষক । ধরনীর সকল মানুষের সুস্থ শরীরের নিশ্চয়তা ডাক্তারদেরকেই দিতে হবে । ধরনীর কোন একজন মানুষও যতদিন শারীরীক অসুস্থায় ভূগবে ততদিন ডাক্তারদের সাধনা চালিয়ে যেতে হবে । ডাক্তারদের হতে হবে ইবনে সিনা কিংবা অন্য কোন মহামনীষীর চরিত্রের । কথায় কথায় রোগীদেরকে বিপদে ফেলা কোন প্রকৃত ডাক্তারের ধর্ম হতে পারে না । ডাক্তারদের সবচেয়ে বড় ধর্ম মানবতার সেবা, মানুষের সেবা করা । তাদের জীবনের সকল কিছুর উর্ধ্বে উঠে এ মহৎ কর্মটি সাধন করতে হবে । বাংলাদেশের আর কোন রোগীকে যেন ডাক্তারদের দায়িত্বহীন সিদ্ধান্তের কারনে শারীরীক এবং মানসিক ভাবে কষ্ট পেতে না হয় সে দিকে আজকের এবং আগামীর ডাক্তারদের কাছে মনোযোগ দেয়ার করুন আর্তি জানাই । জাতি স্রষ্টার পরে ডাক্তার দেরকে স্থান দিয়ে রেখেছে । সুতরাং ডাক্তাররা যেন এমন কোন সিদ্ধান্ত কারো প্ররোচনায় গ্রহন না করে যাতে তাদেরকে মানুষের হৃদয়ের উচ্চ আসন থেকে নামিয়ে ফেলে । ডাক্তারদের কাছে করজোর অনুরোধ, ভবিষ্যতে তাদের আর কোন সিদ্ধান্ত যেন কোন রোগীর কিংবা রোগীর আত্মীয় স্বজনের কষ্টের কারন হয়ে না দাঁড়ায় ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
raju69mathbaria@gmail.com