বাজারে লিচু উঠতে শুরু করেছে, দামও বেশ চড়া। বৈশাখের শেষ আর জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের শহর-গ্রাম সর্বত্রই ছেলে-বুড়ো সবার অতি প্রিয় একটি ফল লিচু।
লিচুর বেশ কয়েক প্রকার জাত রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া যায় মাত্র কয়েকধরনের লিচু। এগুলোর মধ্যে চায়না, চায়না-১, চায়না-৩, বোম্বে ও বেদানা লিচুর চাষ সবচেয়ে বেশি হয়।
এগুলোর মধ্যে বোম্বাই জাতের লিচু পাকলে টকটকে লাল বা রক্ত লাল রঙের হয় এবং সবারই খুব পছন্দের। বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বোম্বাই, চায়না-৩ ও বেদানা লিচুর চাষ হয় সব থেকে বেশি। আর চায়না বা চায়না-১ জাতের লিচু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে এবং গাজীপুর জেলাসহ দেশের প্রায় প্রতিটা জায়গাতেই কম-বেশি বাণিজ্যিক বা শৌখিনভাবে চাষ করা হয়। এদের মধ্যে বোম্বে, চায়না–৩ এবং বেদানা লিচু সবার পরে পাকে।
চায়না জাতের লিচুগুলো পাকলে বোম্বে জাতের লিচুর মতো অতটা টকটকে লাল হয় না। লাল আভাযুক্ত বা বাদামি লাল রঙের হয়। যেহেতু চায়না ও চায়না-১ জাতের লিচু (সাধারণ মানুষ এ জাতের লিচুকে সোনারগাঁও এবং গাজীপুরের লিচু নামে চেনে) সবার আগে পাকে এবং বাজারে আসে তাই অসাধু ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় নানা উপায়ে সাধরণ মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করেন।
বর্তমানে বাজারে লিচু আসতে শুরু করেছে। প্রতি একশ’ লিচু বিক্রি হচ্ছে আকার ও স্থানবিশেষে ৩৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকায় । লিচুর আগাম মুনাফা লাভের আশায় অপরিপক্ক লিচু যেমন আমাদের খেতে বাধ্য করা হচ্ছে, তেমনি ভয়ানক তথ্য হচ্ছে- এই লিচু বিশেষ করে চায়না ও চায়না-১ বা সোনারগাঁওয়ের লিচু টকটকে লাল হয় না বলে একে লাল রঙের করতে এবং সাইজে একটু বড় করতে ইউরিয়া সারের সঙ্গে পাকা মরিচ গুলিয়ে স্প্রে করা হয় গাছে থাকা অবস্থায়।
সোনারগাঁওয়ের লিচু বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, বাগানের টল ঘরের পাশেই ইউরিয়া সার আর পাকা মরিচ জমা করে রাখা।
বাগানে ইউরিয়া সার এবং পাকা মরিচ কেন জিজ্ঞেস করা হলে বাগান পরিচর্যাকারী ব্যক্তি কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি।
স্থানীয় লোকদের সঙ্গে এবং যারা বাগানের লিচু কুড়িয়ে খান তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনাজপুরের লিচু (বোম্বাই জাতের) বাজারে আসা শুরু হলে এ অঞ্চলের লিচুর চাহিদা কমে যাবে আর দামও কমতে থাকবে। তাই বেশি দামে অপরিপক্ক লিচু বিক্রির জন্য এবং ক্রেতা সাধারণকে আকৃষ্ট করার জন্য ইউরিয়া সারের সঙ্গে পাকা মরিচ মিশিয়ে সরাসরি লিচুর উপর স্প্রে করা হয় রাতের বেলা। ফলে সকালে লিচু কিছুটা বড় আকার ধারণ করে, আর রঙও হয় লাল টকটকে। এতে ক্রেতার কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়া যায়।
ইউরিয়া সার একধরনের রাসায়নিক যা জমিতে বা গাছের গোড়ায় দিতে হয়। গাছে ফুল ও ফল ধরার অন্তত এক-দেড় মাস আগে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু মাত্র একদিন বা দু’দিন আগে সরাসরি ফলের উপর স্প্রে করে প্রয়োগের কারণে ইউরিয়া সার সরাসরি মানুষের পেটে চলে যাচ্ছে।
যেকোনো রাসায়নিকই মানুষের শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। সাধারণত পোকার হাত থেকে ফল রক্ষা করার জন্য বা বড় করার জন্য কীটনাশক ও হরমোন প্রয়োগ করলে কমপক্ষে পনের দিন পর সে ফল খেতে হয়। সেখানে মাত্র একদিন বা দু’দিন আগে ইউরিয়া সার পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করার কারণে ফলের উপরের আবরণ ভেদ করে তা ভিতরে চলে যায় আর তা সরাসারি মানুষের পেটে চলে যায় পরবর্তী দু’তিন দিনের মধ্যেই।
এর ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। পেটে প্রচণ্ড ব্যথাসহ বমি হতে পারে, তাছাড়া দীর্ঘ প্রভাবে কিডনি নষ্ট, লিভার ফাংশন দুর্বল, পাকস্থলিতে ঘা, ক্যান্সার ইত্যাদিসহ আরো নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে উত্তরাঞ্চলের বাগান থেকে লিচু কুড়িয়ে খেয়ে বেশ কিছু শিশু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে মারাও গিয়েছিল কয়েকজন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেহেতু এদেশে অপরাধের বিচার হয় না, তাই সতর্ক হতে হবে ভোক্তা সাধারণকেই। প্রাকৃতিক স্বাভাবিক রঙের চেয়ে অতি উজ্জ্বল বা ক্ষীণ রঙের কোনো কিছুই ভালো নয়। তাই বাজার থেকে ভালোভাবে পরখ করে এবং তারাহুড়ো না করে ধীর-স্থির ভাবে যাচাই-বাছাই করে লিচু কেনা উচিত, তাতে ওইসব অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ কম পাবে এবং ভোক্তা সাধারণেরও ক্ষতির সম্ভাবনা কম।
নতুন বার্তা