ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে সদর আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সঙ্গে একরামের বিরোধের বিষয়টি। বলা হচ্ছে, নিজাম হাজারী ফেনীর রাজনীতিতে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন একরামকে।
১৯৮৩ সাল থেকে ফেনীর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন একরাম। জয়নাল হাজারীর অনুসারী ছিলেন তিনি। এক-এগারোর সময় জয়নাল হাজারী ফেনী থেকে বিতাড়িত হলেও জেলার রাজনীতিতে অবস্থান ধরে রাখেন তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন একরাম। তবে রাজনৈতিক কৌশলে ধরাশায়ী হয়ে মনোনয়নবঞ্চিত হতে হয় তাঁকে। তবে পিছু হটেননি তিনি। অভিযোগ আছে, মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর নিজাম হাজারী তাঁকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য উৎসাহ দেন, যাতে এ ছুতো ধরে পরে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করার সুযোগ পাওয়া যায়। তবে সে প্রলোভনে পা দেননি একরাম। আবারও নির্বাচন করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে। তত দিনে ফেনীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান নিজাম উদ্দিন হাজারী। এমপি হয়ে উপজেলা নির্বাচনেও একরামকে অসহযোগিতা করতে শুরু করেন তিনি। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শুধু নিজের রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে একরাম জিতে আসেন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে।
নিজাম হাজারী ফেনীতে ঘাঁটি করে নেওয়ার পর এ পর্যন্ত একরামের সঙ্গে ছোট-বড় অসংখ্য বিরোধের সৃষ্টি হয়। ফেনীর কয়েকজন প্রবীণ নেতা বলেন, এত বড় একটি ঘটনা ঘটেছে ফেনীতে, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা নেই বললেই চলে। মুখ খুলতে চান না অনেকেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেন্ডার বাণিজ্য, ফেনীর ডায়াবেটিক হাসপাতালের আধিপত্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি ঘোষণা নিয়ে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম হাজারীর সঙ্গে একরামের বিরোধ শুরু হয়। ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন একরাম চেয়ারম্যান। এ নিয়ে দু-তিন দফা নিজাম হাজারীর বাহিনীকে আটকে রাখে একরামের দলবল। ডায়াবেটিক হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ ছিল একরামের কাছে। গত বছর এর আধিপত্য নিতে যায় নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর ‘বুদ্ধিদাতা’ হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীর কবির আদেল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন অর রশীদ। তাঁরা ডায়াবেটিক হাসপাতালে একরামের রুমে তালাও ঝুলিয়ে দেন। পরে জেলার অন্য নেতাদের মধ্যস্থতায় আধিপত্য একরামেরই থাকে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে চরম বিরোধ সৃষ্টি হয় নিজাম হাজারীর সঙ্গে একরামের। একরামের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফুলগাজী উপজেলায় একরাম চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হন। এটা মেনে নেননি নিজাম হাজারী। ফলে নির্বাচনে পরাজিত করতে ভেতরে ভেতরে নিজাম হাজারী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মিনার চৌধুরীর সঙ্গে হাত মেলান। এতে বেকায়দায় পড়ে যান একরাম। তবে একরাম উপজেলা নির্বাচনে এমপির বিরোধিতার জবাব দেন অন্যভাবে। একসময়ের নিজাম হাজারী ও একরামের রাজনৈতিক গুরু ফেনীর গডফাদারখ্যাত জয়নাল হাজারীকে হেলিকপ্টারযোগে ফেনী পাইলট হাই স্কুল মাঠে নিয়ে আসেন একরাম। বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে নিজাম হাজারীকে হুমকি প্রদর্শন করে একরাম। এ বিষয়টিও ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে নিজাম হাজারীকে। এর ফলে দুজনের বিরোধ আরো চাঙ্গা হতে শুরু করে। নিজাম হাজারী তখন থেকে মনে করে, জয়নাল হাজারীর সঙ্গে একরামের যোগাযোগ রয়েছে। এটি যেকোনো সময়ে তাঁর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এরই সূত্র ধরে উপজেলা নির্বাচনে একরামের নির্বাচনী গণসংযোগেও প্রথম প্রথম যাননি নিজাম হাজারী। বরং অভিযোগ আছে, একরামের নির্বাচনী গণসংযোগে নিজাম বাহিনীর লোকজন কয়েক দফা হামলা চালায়। আরো অভিযোগ আছে, একরামের নির্বাচনী প্রচারণায় থাকা দুটি গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় নিজাম বাহিনীর দলবল। অবশ্য পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যস্থতা ও কেন্দ্রীয় উদ্যোগের ফলে নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে একরামের পক্ষে সমর্থন দেন নিজাম হাজারী।
আরো জানা গেছে, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন ফুলগাজী উপজেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদ চৌধুরী। এলাকায় তাঁর নেতিবাচক ইমেজের কারণে একরাম তাঁকে প্রার্থী হতে দিতে চাননি। জানা গেছে, জাহিদ চৌধুরী নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ কর্মী। একরামের এ আচরণেও ক্ষুব্ধ হন নিজাম হাজারী ও জাহিদ চৌধুরী।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে সাজা কম খেটে জালিয়াতি করে জেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, এর সঙ্গে একরামের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সন্দেহ করে নিজাম হাজারী। এ বিষয়টি নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন নিজাম হাজারী। একরামকে সরাসরি দোষারোপ করেন তিনি। একরামের ঘনিষ্ঠ আরেক সহকর্মী জানান, নিজাম হাজারী একরামকে দেখে নেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন। একরামের রাজনৈতিক সহকর্মী দুজন নেতা বলেন, ফেনীতে নিজাম হাজারী সব সময় তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন একরামকে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ‘একরামের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক কোনো বিরোধ ছিল না। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
সূত্র : দৈনিক কালের কন্ঠ ।