নারায়নগঞ্জে ৭ খুন এবং ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যান নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়ে গেলেও খুন ও অপহরণ বন্ধ হচ্ছে না। অপরাধীদের ধরার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্বেও অপরাধের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। আর হত্যাকা-ের ঘটনায় তদন্ত কাজ শেষ হওয়ার আগেই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একে অন্যকে দায়ী করে নানা বক্তব্য দেয়ায় মূল অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তারা আশ্রয় পাচ্ছে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছেই।
সারাদেশে সাম্প্রতিক খুনের ঘটনাগুলো নিয়ে আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে নীরব দ্বন্দ্বও চলছে। আর এ কারণে সন্ত্রাসীরাও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। তারা ধরেই নিচ্ছে যে, তাদের আর বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেয়েও তাদের সাহস বেড়ে যাচ্ছে।
নারায়নগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় মূল অপরাধীদের ধরার জন্য পুলিশ যত তৎপর তার চেয়ে অনেক বেশী তৎপর রাজনীতিকরা একে অন্যকে দোষারোপ করার জন্য। এই মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে একসময় যে র্যাব সুনামের সাথে কাজ করে জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল সেই র্যাবকে আজ অপরাধীদের তালিকায় ফেলা হচ্ছে। র্যাবকে বিলুপ্তির দাবিও উঠছে।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের হত্যাকা-ের ঘটনায়ও মূল অপরাধীদের ধরার চেয়ে দায়িত্বশীল রাজনীতিকরা একে অন্যকে দায়ী করে যাচ্ছেন। সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারীকে রিমা-ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই হত্যাকা-ের রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। অন্যদিকে জয়নাল হাজারী সরাসরি বলে দিয়েছেন, একরাম হত্যাকা-ের মূল হোতা নিজাম উদ্দিন হাজারী। স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর শিবলুকে দিয়ে নিজাম এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমন বক্তব্য আর পাল্টা বক্তব্যে অপরাধীরা দূর থেকে হাসছে। একের পর এক অপরাধ ঘটিয়েই যাচ্ছে। বুধবার মধ্যরাতে লক্ষীপুরে আওয়ামী লীগের দুই নেতা খুন হয়েছেন। সদর উপজেলার চরশাহী ইউনিয়নের রামপুর গ্রাম থেকে চরশাহী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মন্নান ভূঁইয়ার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রায়পুর পৌর শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে চরপাতা গ্রাম থেকে।
বৃহষ্পতিবার বগুড়া শহরের রহমান নগর এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন যুবলীগ কর্মী শিপলু। এ তিনটি ঘটনায়ও কেউ গ্রেফতার হয়নি। হত্যাসহ বড় ধরণের অপরাধের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীরা গ্রেফতার না হওয়ায় অপরাধীদের সাহস বেড়ে যাচ্ছে এবং তারা হত্যা, অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আর এসব ঘটনা জনমনে আতংক বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীদের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহার করায় তারা সব সময়ই প্রশ্রয় পেয়ে গেছে। বড় ধরণের অপরাধের পরও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে তারা গ্রেফতার এড়িয়ে গেছে এবং বেকায়দায় পড়লে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকেই তারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। আর এসব অপরাধী প্রয়োজনে দল পরিবর্তন করে অন্য দলের আনুকূল্য পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে অপরাধীরা অপরাধ করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন আর অপরাধের ক্ষেত্রে কোন বাছ বিচার করার চিন্তা করে না। কে তার অপরাধের শিকার হচ্ছেন তাও বিবেচনা করে না। আর এ কারণেই নিজ দলের এক নেতার নির্দেশে খুন হচ্ছেন অন্য নেতা। তবে এক নেতার নির্দেশে অন্য নেতা খুন হওয়ার বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ হলেও দলের নেতারাই এসব বক্তব্য দিয়ে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহি:প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তদন্ত শুরু হলেও অনেক সময়ই তদন্ত শেষ হয় না এবং বিচার কাজও সম্পন্ন হয় না। অনেক সময়ই ঘটনা ধামা চাপা পড়ে যায়। অপরাধীরা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এভাবেই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং বিনাদ্বিধায় ঘটিয়ে যাচ্ছে হত্যা, গুম, অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনা। আর এসব ঘটনা নিয়ে কয়েকদিন উত্তাল হয়ে থাকছে স্ব স্ব এলাকা। সড়ক অবরোধ, ভাঙচুর, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী হচ্ছে। পুলিশও কিছুদিন তৎপর হচ্ছে। মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানী বাড়ছে। কিন্তু মূল অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। এ অবস্থা আর কতদিন মেনে নেবে এদেশের মানুষ?