১৯৬৪ থেকে ২০১৪। পুরো ৫০ বছর। চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে খ্যাত কবরী স্পর্শ করলেন অভিনয় জীবনের ৫০ বছরের মাইলফলক। কবরীর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবন নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন
জন্ম ১৯৫০ সালের ৯ই জুলাই। নায়িকা হিসেবে প্রথম ছবি মুক্তি ১৯৬৪ সালের ২২শে এপ্রিল। সে হিসেবে মাত্র ১৪ বছর বয়সে নায়িকা। তা-ও আবার প্রথম ছবিতেই সাফল্য। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবিতে কবরীর নায়ক সুভাষ দত্ত নিজেই। নতুন করে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প পেলো মিষ্টিমুখের একজন নায়িকাকে। প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ থেকেই কবরী হয়ে রইলেন মিষ্টি মেয়ে। আজও দীর্ঘ ৫০ বছর অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেও কবরীর ওপর থেকে মিষ্টতা বিন্দুমাত্র কমেনি। কবরী আজও মিষ্টি মেয়ে। পাশের বাড়ির মেয়েটির মতোই স্নিগ্ধ-নির্মল। চট্টগ্রামের মেয়ে কবরী। কিশোরী বয়সে সিনেমায় এসে দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন পরিণত শিল্পী। এক সময় হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সব ধরনের ছবিতেই অভিনয় করে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে থাকেন। যদিও গ্রামীণ চরিত্রে কবরী নিজেকে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপরও রোমান্টিক ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে জুটিবেঁধে তিনি নিজেকে সেরা হিসেবে স্বীকৃত করেছেন। তবে গ্রামীণ চরিত্রে কবরীর শ্রেষ্ঠত্বকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন চলচ্চিত্রে তারই একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী শাবানা। সব ধরনের ছবিতে সব ধরনের চরিত্রে শাবানার সাফল্যও বিশাল। কিন্তু শাবানা যখন প্রযোজক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, অভিনেত্রী শাবানাকে সবার উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার এসএস প্রোডাকশন যখন তৎপর, ঠিক তখনই শাবানা বিশিষ্ট পরিচালক আজিজুর রহমানকে দিয়ে ‘সোনার তরী’ নামে একটি গ্রামীণ গল্পের পটভূমিকায় ছবি নির্মাণের সময় নিজে অভিনয় না করে এ ছবির নায়িকা চরিত্রের জন্য কবরীকে নিয়েছিলেন। তখন সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে যায় অভিনেত্রী হিসেবে চরিত্রের জন্য শাবানার সঙ্গে কবরীর পার্থক্য। অবশ্য তার আগেও আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বউ’, খান আতার ‘সুজন সখি’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিগুলোতে দুর্দান্ত অভিনয় করে গ্রামীণ চরিত্রের নায়িকার আসনটি নিজের দখলে রেখে দিয়েছিলেন কবরী। আর প্রেমের ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে এই জুটি তো সর্বকালের সেরা। রাজ্জাক-কবরী জুটির ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’, ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘আগন্তুক’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘কত যে মিনতি’, ‘অধিকার’, ‘দীপ নিভে নাই’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘স্মৃতিটুক থাক’, ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘কাঁচকাটা হীরে’, ‘উপহার’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘আমাদের সন্তান’ পর্যন্ত রাজ্জাক-কবরী জুটির কথা সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা ভুলতে পারেননি। কবরী রাজ্জাকের সঙ্গে যেমন সফল তেমনি সফল ফারুক, সোহেল রানা, আলমগীর এবং উজ্জলের সঙ্গেও। উজ্জলের প্রথম ছবি ‘বিনিময়’-এর নায়িকা কবরী। সোহেল রানার প্রথম ছবি মাসুদ রানার নায়িকাও কবরী। ফারুকের প্রথম ছবি ‘জলছবি’র নায়িকাও কবরী। আলমগীরের প্রথম ছবি ‘আমার জন্মভূমি’তেও নায়িকা কবরী। যদিও এ ছবিতে রাজ্জাক ছিলেন। তারপরও চারজন নতুন নায়কের প্রথম ছবিতে অভিনয় করার কৃতিত্বটাও একমাত্র কবরীর। কবরীর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে যেমন ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘হীরামন’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘পারুলের সংসার’, ‘মতিমহল’, ‘সাগর ভাসা’র মতো পোশাকী ছবি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ‘বাহানা’র মতো উর্দু ছবি। আর শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’-এর পার্বতী তো কবরীকে অমর করে রেখেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে হাতেগোনা যে ক’জন অভিনেত্রী রয়েছেন, যাদেরকে মানহীন ছবিতে খুব একটা দেখা যায়নি, তাদের মধ্যে কবরী অবশ্যই একজন। তারপরও রহস্যজনক কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অভিনেত্রী তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি বলেই তার বিশাল ভক্তবাহিনীর অভিযোগ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কবরী মাত্র একবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৮ সালে কবরী আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বউ’ ছবির জন্য এ পুরস্কার পান। তবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা গুণী এই অভিনেত্রীকে মূল্যায়ন করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। কবরী শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি ‘বাচসাস’ পুরস্কার পেয়েছেন চারবার। ১৯৭২-৭৩ সালে ‘লালন ফকির’, ১৯৭৫ সালে ‘সুজন সখি’, ‘১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’, ১৯৮৮ সালে ‘দুই জীবন’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং ২০০৮ সালে বাচসাস কবরীকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবরী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন এসিডদগ্ধ নারীদের যন্ত্রণাময় জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র ‘আয়না’। ছবিটি সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করলেও বরাবরের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে থেকে যায় উপেক্ষিত। তবে অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত সফলতা দেখিয়েছেন কবরী। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কবরী আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের মুখ উজ্জ্বল করেন। দীর্ঘ ৫ বছর তিনি জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় উপ-কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অভিনেত্রী কবরী আর জনগণের নেত্রী সারাহ বেগম কবরী সাধারণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন প্রেক্ষাগৃহের পর্দা থেকে রাজনীতির মঞ্চ পর্যন্ত। রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও মনের টানে অভিনয়ও করেছেন ‘তুমি আমার স্বামী’, ‘রাজা সূর্য খাঁ’ ছবিতে। চলচ্চিত্র শিল্পের যে কোন প্রয়োজনে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। চলচ্চিত্র শিল্পের ডাকে সাড়া দিয়েছেন সব সময়। তাই তো তার অভিনয়ের ৫০ বছর পূর্ণ করা নিয়ে গণমাধ্যম চেষ্টা করেছে যথাযথ মূল্যায়ন করতে। কবরী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষণজন্মা শিল্পীদের একজন। সেই কিশোরী বয়স থেকে আজকের পরিণত বয়সে এসে কবরী আপনজনদের কাছে একই রকম। ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আড্ডায় উচ্ছল, চঞ্চল-প্রাণবন্ত। সত্যকথা অকপটে বলতে পারেন। চলচ্চিত্র নিয়ে কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো সৎসাহস নিয়ে আজও কবরী সবার কাছে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবেই আছেন। থাকবেন অনন্তকাল।