পশ্চিমাদের বোঝানো কঠিন হবে শেখ হাসিনা তা নিশ্চিত করেই জানতেন। প্রাচীন গ্রিসে জন্ম নেয়া গণতন্ত্র পশ্চিমা দুনিয়াতে লালিত-পালিত হয়েছে বছরের পর বছর। জনগণের সম্মতি যে গণতন্ত্রের মর্মবাণী। ৫ই জানুয়ারির বাংলাদেশের নির্বাচন যে কারণে পশ্চিম দুনিয়ায় গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের চাপের মুখে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিকল্পের প্রয়োজন ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের নিরঙ্কুশ সমর্থন তিনি সব সময়ই পেয়েছেন। শপথ নেয়ার পর প্রথম অভিনন্দন বার্তা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে শুধু ভারতের ওপর নির্ভর করে যে সব কিছু সামলানো যাবে না তা তিনি দ্রুতই বুঝতে পারেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির দুই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে এ সময় পাশে পায় আওয়ামী লীগ সরকার। দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্র লিখে গেছেন, ব্যক্তি অথবা রাষ্ট্র একই বিষয়। প্রত্যেকেই স্বার্থপর। সেই স্বার্থপরতার কারণেই আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে এগিয়ে আসে চীন ও রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বন্ধুত্ব অবশ্য নতুন কিছু নয়। তবে চীনের সিদ্ধান্ত একেবারেই চমক জাগানিয়া। যে চীনা রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের কিছুদিন আগেও বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন সে চীনই বদলে যায় রাতারাতি। এখন অবশ্য স্পষ্ট পদ্মা সেতুসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পাওয়ার বিনিময়েই এ সমর্থন দেয় চীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন চীন সফরে রয়েছেন। তার এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। চীনের আগে জাপান সফরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ওই সফরে জাপানের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত শিরো সাদোশিমা ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনকে বৈধ বলে উল্লেখ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পশ্চিমের পরিবর্তে পূর্বের দিকে নজর দিতেও বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। চীন-ভারতের বাইরে রাশিয়ার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ সরকার। রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। গণতন্ত্রের কোন মডেল বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা নেই বলে কিছুদিন আগেই জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেসান্দর নিকোলায়েভ। চীন ও ভারতেরও একই মত বলে তিনি দাবি করেছিলেন। ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন অবশ্য পরে এ বক্তব্যের জবাব দেন। গিবসন বলেন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই গণতান্ত্রিক শাসন। এটা কমনওয়েলথের ভাবধারা। রাশিয়া ও চীন কমনওয়েলথের সদস্য না। কিন্তু বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য। তাই কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে বৃটেন এ ব্যাপারে কথা বলতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শিগগিরই বৃটেন সফরে আমন্ত্রণ জানানোর কোন পরিকল্পনা নেই বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি। দৃশ্যত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্নে আন্তর্জাতিক দুনিয়া এখন দুই ভাগে বিভক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মনে করে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের মতামতের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটেনি। ১৫৪টি আসনে কোন ধরনের ভোট না হওয়ার কারণে এ সব আসনের জনগণ মতামত দেয়ার সুযোগই পাননি। যে ১৪৭টি আসনে ভোট হয়েছে সেখানে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না। একই সঙ্গে সহিংসতার কারণেও মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি। এ কারণে পশ্চিমা বিশ্ব একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সংলাপে বসার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। যদিও সরকার এখন পর্যন্ত এ আহ্বানে কোন সাড়া দেয়নি। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি জোরেশোরে উঠলেও বৈধতার প্রশ্ন সেভাবে উত্থাপিত হয়নি। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনায় সরকার চাপের মুখে থাকলেও দেশে এখন পর্যন্ত সরকারবিরোধী কোন আন্দোলন তৈরি হয়নি। তবে আদালতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে সরকারের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে জারি করা এক রুলের শুনানি শুরু হয়েছে হাইকোর্টে। এ রুলে এখন পর্যন্ত তিনজন এমিকাস কিউরি গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন সংবিধান সমর্থন করে না বলেই মত দিয়েছেন প্রবীণ আইনবিদ ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বর্তমান সংসদ সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের আলোকে সংসদ নয় বলেও মত তাদের। এ মামলায় সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির এমিকাস কিউরি হিসেবে মত দেয়ার বাকি রয়েছে। যদিও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে এমিকাস কিউরি হিসেবে মত দেয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। সাবেক এ আইনমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটিরও সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার রায় কোন দিকে যায় তার ওপর বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। যেমনটা ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের বাংলাদেশ নীতির ওপরও নির্ভর করছে বহু কিছু। শিগগিরই সে নীতি খোলাসা হয়ে যাবে বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। যুদ্ধাপরাধ আর জামায়াতের বিচারের ক্ষেত্রে সরকার এক ধরনের ধীরে চলা নীতিই অনুসরণ করছে। বিশেষ করে দল হিসেবে শিগগিরই জামায়াতের বিচারের কোন সম্ভাবনা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের অবশ্য বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ নেই। কারণ ওই সব দেশেই গণতন্ত্র নেই। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশের আগ্রহ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ আর আন্তর্জাতিক চাপ সামলে যত দিন সম্ভব ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পূর্বমুখী নীতি অনুসরণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নীতি তাকে কতটুকু সাফল্য দেয়, তাই এখন দেখার বিষয়।