দুই ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটে টেলিভিশন কিনতে এসেছেন প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। থাকেন খিলগাঁও। ছেলেদের আবদারে ৩৮ হাজার টাকায় কিনেছেন ৩২ ইঞ্চি এলইডি টেলিভিশন।
হঠাৎ এই টেলিভিশন কেনার উপলক্ষ আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপ। আর এ জন্য নিজেদের জমানো ১৮ হাজার টাকাও বাবাকে দিয়েছে তাঁর দুই ছেলে। তিনি জানালেন, তাঁর বাসায় আগে থেকেই টেলিভিশন আছে। তার পরও কেন কিনলেন?—জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘ছেলেদের পীড়াপীড়িতে টেলিভিশন কিনতে হলো। এলইডি টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখতে চায় ওরা।’
আজ থেকে ব্রাজিলে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ সামনে রেখে রফিকুল ইসলামের ছেলেদের মতো ফুটবলপ্রেমীরা ছুটছেন টেলিভিশন বিক্রির শোরুমগুলোতে। আর যাঁদের খেলা দেখায় আগ্রহ কম, তাঁরাও টেলিভিশন কিনতে শোরুমে ভিড় করছেন প্রিয়জনের আবদার পূরণের জন্য।
প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্বকাপ উপলক্ষে টেলিভিশনের বাজার জমে উঠেছে। মাস খানেক ধরেই শোরুমগুলোতে ভালো বেচাবিক্রি হচ্ছে। তবে এবার এলইডি টেলিভিশন বেচাবিক্রির প্রবণতাটা চোখে পড়ার মতো।
আবার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর টেলিভিশন বিক্রি যতটা হচ্ছে, সাধারণ ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি ততটা ভালো নয়। তবে এসব শোরুমের বিক্রয়কর্মীরাও স্বীকার করছেন, এখনকার বিক্রিও বছরের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো।
টেলিভিশনের বিক্রি বাড়াতে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে নানা ধরনের ছাড়। তার মধ্যে রয়েছে নগদ অর্থ ছাড়, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের দলগুলোর টি-শার্ট, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে আরও অনেক উপহার। একটি কিনলে আর একটি ফ্রির মতো সুযোগও দিচ্ছে কোনো কোনো কোম্পানি৷ রাজধানীর স্টেডিয়াম মার্কেট, গুলশান, কারওয়ান বাজার এবং বিজয় সরণিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
দীর্ঘদিন বাজারে বড় আকারের যেসব টেলিভিশন ছিল, সেগুলো মূলত ক্যাথোড রে টিউব বা সিআরটি টেলিভিশন। মাঝখানে এলসিডি টেলিভিশন জনপ্রিয় হলেও তবে এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে সে জায়গা দখল করেছে এলইডি টেলিভিশন। দাম কমে আসা, আকর্ষণীয় গঠন, সহজে বহনযোগ্য এবং উন্নত প্রযুক্তির হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই টেলিভিশনগুলো।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে সনি, স্যামসাং, এলজি, শার্প, সিঙ্গারের মতো বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি যেমন বেড়েছে, তেমনি বিক্রি বেড়েছে ওয়ালটন, টিসিএল, মাই ওয়ান, কংকার মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর টেলিভিশনের।
এখন মাত্র ১৫ হাজার টাকাতেই মিলছে কংকা, সিঙ্গার, ওয়ালটনের ১৯ ইঞ্চির এলইডি টেলিভিশন। তুলনামূলক কম পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর এলইডি টিভি পাওয়া যাচ্ছে ১০ হাজার টাকার মধ্যেও। আবার সনি, স্যামসাং ব্র্যান্ডের কয়েকটি মডেলের বিশালায়তন (৬২ ইঞ্চি) টেলিভিশনের দাম ১০ লাখ টাকা। এবার উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য কয়েকটি কোম্পানি নিয়ে এসেছে ‘কার্ভ’ বা ‘বাঁকানো’ টেলিভিশন।
কংকা টেলিভিশনের পরিবেশক ইলেকট্রো মার্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান বিক্রয় ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বকাপ উপলক্ষে আমরা এলইডি টেলিভিশনের তিনটি নতুন মডেল বাজারে ছেড়েছি। মে মাসে আমাদের দুই হাজারের মতো টেলিভিশন বিক্রি হয়েছে, এই মাসে পাঁচ হাজারের মতো হবে বলে আশা করছি।’ তিনি জানান, সারা বছর তাঁদের যে পরিমাণ টেলিভিশন বিক্রি হয়, শুধু জুন ও জুলাই মাসেই এর ৬০ শতাংশ বিক্রির পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।
স্টেডিয়াম মার্কেটে সনির একটি শোরুমে গত সোমবার ও মঙ্গলবার ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা গেছে। এ শোরুমে শুধু এলইডি টেলিভিশনই বিক্রি হচ্ছে। শোরুমের বিক্রয় নির্বাহী আহমেদ রেজাউল করিম জানান, মূলত দাম কমে যাওয়ার কারণেই এলইডি টিভি বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে।
ওই শোরুমে ঘুরে ঘুরে টেলিভিশনের বিভিন্ন মডেল দেখছিলেন পল্টন থেকে আসা শোয়েব রহমান ও আফসানা আক্তার দম্পতি। তাঁরা জানালেন, আপাতত দেখতে এসেছেন। এখনই কিনছেন না। তবে বিশ্বকাপ উপলক্ষে একটি টিভি কিনবেন।
অল্প পরিচিত ব্র্যান্ডের টেলিভিশনের বিক্রি তুলনামূলক কম। স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি দোকানের বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেও এর প্রমাণ মিলল। তাঁর দোকানে চীন থেকে আমদানি হওয়া বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টেলিভিশন বিক্রি করা হয়। জাহাঙ্গীর জানান, জুন মাসে বিক্রির জন্য ৩৬টি টেলিভিশন তিনি নিয়ে এসেছিলেন। তবে ১০ তারিখ পর্যন্ত মাত্র তিনটি টেলিভিশন বিক্রি করতে পেরেছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৩ লাখ টেলিভিশন প্রস্তুত ও সংযোজন করা হয়। এর বাইরে আমদানি হয় আরও দুই লাখ টেলিভিশন। গেল বছর ১৫ লাখের বেশি টেলিভিশন বিক্রি হয়, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫০০ কোটি টাকা। আর এই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিক্রি সাত লাখ ছাড়িয়েছে বলে সমিতির অনুমান।