ওরা নারী; ওরা শ্রমিক, ওরা অসহায়। সন্তান, সংসার ও জীবন বাঁচাতে ওরা হাড়ভাঙা কষ্ট করে। সংসারের রান্নাবান্না, ঘর গোছানো থেকে স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়িসহ আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ন থেকে শুরু করে সব দিক খেয়াল রাখতে হয় একজন নারীকে। পাশাপাশি হতদরিদ্র পরিবারের একজন নারী হাতে নেয় রান্নার খুন্তির পরিবর্তে মাটি কাটার কোদাল, মাথায় নেয় মাটির ঝুড়ি। ঘরের বধূ সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে কখনো গার্মেন্টশ্রমিক, কল-কারখানার শ্রমিক কখনো বা অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করেন। এতকিছু করছেন শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশায়। তারপরেও ওদের প্রতি এখনো রয়েছে আমাদের মতো বোদ্ধা, সুশীল সমাজের বৈষম্যমূলক আচারণ। ওরা তো মা! ওদেরও মন চায় সন্তানরা শিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজে বসবাস করুক। তাদের ন্যায্য অধিকার-প্রাপ্যতা পেয়ে বসবাস করবে। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা তো পূরণ হওয়ার নয়। কারণ দুমুঠো অন্নের সন্ধানে যাদের সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয় তাদের সন্তানরা আবার মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজে বাস করবে এটা কি কখনো ভাবা যায়? ২০০৪ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তি ৪৪.৩ মিলিয়ন, যার মধ্যে নারী ৯.৮ মিলিয়ন। এরপর এত পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট নারীশ্রমিকের ৮৩% ভাগ গৃহশ্রমিক, ১০% ভাগ আত্মকর্মসংস্থান নিয়োজিত ৪% ভাগ বেতনভোগী, ৩% ভাগ দিনমজুর। মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ১২৭ বছর আগে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে এ দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের দিন হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর এ দিবসটি ধুমধামে পালিত হয়ে থাকে। আমরা সুশীল সমাজ জোরালো কণ্ঠে বলি_ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা, নারীদের অধিকার, নারীশ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে যারা জোরালো কণ্ঠে বলছেন তারাই হয়তো শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছেন। সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ঘোষনায় বা সনদে বলা হয়েছে। কিন্তু সমঅধিকারের কথা বলা থাকলেও একটা বিরাট বৈষম্য চোখে পড়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পরিবারে, কল-কারখানায়, কৃষিতে, ব্যবসায়, প্রশাসনে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও শুধু নারী হওয়ার কারণে আজো পৃথিবীর প্রতিটি কোণে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ সনদ স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ, সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সব স্তরে যেমন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে নারীর অংশগ্রহণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে পুরুষের সঙ্গে নারীর অধিকারকে সমান স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষভেদে সেখানে কোনো পার্থক্য করা হয়নি বরং নারীদের এগিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ আইন প্রণয়নের কথাও বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখন পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও শতভাগ কাজ করে থাকে। শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়, গ্রামের অনেক সংগ্রামী নারীরাও কাজ করছেন সমানতালে। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা যখন দেয়া না হয় তখন আমাদের মূল্যবোধ, বিবেক মানবতা কোথায় থাকছে? বাস্তবতা হচ্ছে আমরা যারা আইন তৈরি করছি তারা বাস্তবে কি একটিবারও দেখেছেন শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে কিনা? বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৪-এ বলা হয়েছে_ ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তিদান করা। অনুচ্ছেদ ১৫-এ বলা হয়েছে_ কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার। অনুচ্ছেদ ২০-এ বলা হয়েছে_ কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী_ এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন।’ শ্রম আইনের ৩৪৫ ধারায় বলা হয়েছে_ ‘কোন শ্রমিকের জন্য কোনো মজুরি নির্ধারণ বা নিম্নতম মজুরির হারের ক্ষেত্রে, একই প্রকৃতির বা একই মান বা মূল্যের কাজের জন্য ১৮৪ [মহিলা, পুরুষ এবং প্রতিবন্ধী] শ্রমিকদের জন্য সমান মজুরির নীতি অনুসরণ করিতে হইবে; এবং এতদসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে ১৮৫ [নারী-পুরুষ-প্রতিবন্ধী] ভেদের কারণে কোনো বৈষম্য করা যাইবে না’। ২৮৯ ধারার (১)এ বলা হয়েছে_ কোনো মালিক একাদশ অধ্যায়ের অধীন ঘোষিত নিম্নতম মজুরি হারের কম হারে কোনো শ্রমিককে মজুরি প্রদান করিলে, তিনি এক বছর পর্যন্ত কারাদ-ে, অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে, অথবা উভয় দ-ে দ-নীয় হইবেন’ কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির কম দেয়ার অপরাধে মালিক পক্ষকে সাজা দেয়া হয়েছে। ইসলামও শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এখন থেকে দেড় হাজার বছর আগে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) শ্রমিকের মেহনতের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্য তিনি যে ঐশ্বরিক বিধান চালু করেছিলেন তাতে শ্রমিক ও শ্রমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার অমোঘ বাণী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজো সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে অতুলনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে ভাই ভাই উল্লেখ করে তিনি তাদের অধিকার ও পাওনার ব্যাপারে যে উক্তি করেছিলেন তা অসাধারণ। মহানবী (স.) শ্রমিককে আপনজনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার কর, তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে।’ একই কথা মহানবী (স.) আরেক হাদিসে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তোমরা অধীনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদের কোনো রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথাদানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি প্রন্তরিকতা প্রদর্শন কর না।’-বুখারি। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি থাকা ও পোশাক দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা তোমাদের কাজ করছে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।’-বুখারি। এ হাদিস থেকে বোঝা গেল মহানবী (স.) শ্রমিকদের তার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করতে বলেছেন। তিনি নারীশ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের কথা বলেননি। তাহলে আসুন_ আমরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা হিস্যা পরিশোধ করি। নারীশ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে সরে এসে তাদের ন্যায্য পাওনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রদান করি। নিজেদের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলি। প্রতিটি শ্রমিকের তার চাকরির শর্ত জানার অধিকার দিই। নারীশ্রমিকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করি।