রাস্তায়, স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে নারীদের ইভটিজিংয়ের ডিজিটাল সংস্করণ ইন্টারনেট নারীদের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট তথা যৌন হয়রানি। একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতার তরুণ, যুবকরা অভিনব কায়দায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া থেকে শুরু করে গৃহবধূ, বয়স্ক, মধ্য বয়স্ক নারীদের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করছে। সেই পর্নো ব্যবসায়ীরা ডলার কামানোর ধান্দায় ওঁৎপেতে আছে।
কেস স্ট্যাডি-১:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাঈমা। ৩ জুন রাত ১টায় অপরিচিত নাম্বার থেকে নাঈমার নাম্বারে একের পর এক কল আসতে শুরু করে। প্রথম কলটি রিসিভ করার পর কল দেওয়া ব্যক্তিটি নাঈমার কাছে জানতে চায়, কত টাকা ফ্লেক্সি দিতে হবে।
অপরিচিত নাম্বার থেকে রাত ১টায় এমন কল পেয়ে অবাক নাঈমা কারণ জানতে চাইতেই ফোন দেওয়া ব্যক্তিটি জানায়, আপনি না ইন্টারনেটে নাম্বার দিয়ে ফোন সেক্সের অফার করেছেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহব্বল নাঈমা লাইন কেটে দেয়। কিন্তু তাতে নিস্তার মেলেনি। এরপর থেকে নাঈমার মোবাইলে একটু পর পর কল আসতেই থাকে। সবার কুপ্রস্তাবে অসহ্য নাঈমা শেষে নিরূপায় হয়ে নাম্বারটি বন্ধ করে নতুন নাম্বার নিতে বাধ্য হয়।
কেস স্ট্যাডি-২:
ঢাকার একটি কলেজ পড়ুয়া ফারিয়া। ফেসবুকে ফারিয়ার কোনো একাউন্ট না থাকলেও কে বা কারা ফারিয়ার ছবি ব্যবহার একটি আইডি খোলে। সেই আইডি থেকে একের পর এক অশ্লীল স্ট্যাটাস, ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন পর্নোছবি আপলোড করে। বন্ধুদের একের পর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ফারিয়াকে।
এভাবে প্রতিদিন শত শত নাঈমা, ফারিয়াকে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার মেয়েরা বেশির ভাগ সময় ঘটনা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে না পেরে একটা অজানা আতঙ্কের মধ্যে বাস করে।
বেশ কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফেসবুক, গুগলে তথ্য সার্চের মাধ্যমে প্রায় ৫০টি ওয়েব সাইট ঘুরে দেখা গেছে ভয়ঙ্কর সব চিত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রাক্তন প্রেমিক, প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়া সহপাঠী, কোনো নারীকে কুপ্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখান হওয়া, প্রবাসীদের বউয়ের সঙ্গে পরকীয়া করতে ব্যর্থ হওয়া এবং ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে। পাশাপাশি আছে একশ্রেণির পর্নো ব্যবসায়ী। যারা সাইট হিট করে গুগল অ্যাড জুড়ে দিয়ে ডলার কামানোর ধান্ধা করে।
যেভাবে ইন্টারনেটে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট চলছে:
ফেসবুক ব্যবহার করে দুইভাবে নারীদের সেক্সুয়াল হ্যারাসম্যান্টের পথ করে দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেইক (ভুয়া) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেই অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল পিকচারজুড়ে দেওয়া হয় ইন্টারনেট থেকে নেওয়া সুন্দরী কোনো মেয়ের ছবি কিংবা ফেসবুক ব্যবহারকারী কোনো মেয়ের ওয়াল থেকে নেওয়া ছবি।
এরপর ফেইক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু হয় বিভিন্ন পর্নো ছবি আপলোড, অশ্লীল সব স্ট্যাটাস দেওয়া। কয়েকদিন পর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিকটিম মেয়েটির মোবাইল নাম্বার ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাস দেয়। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় সেক্সুয়াল বিভিন্ন প্রস্তাব।
ফেইক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি শত শত অশ্লীল পেইজ আছে। যেসব পেইজের অ্যাডমিনরা প্রতিদিন শত শত মেয়ের নাম্বার ওয়ালে পোস্ট করছে। অন্যের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ছবি নিয়ে অশ্লীল পেইজে পোস্ট করে এমন সব নোংরা মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হচ্ছে যা প্রকাশের অযোগ্য।
শুধু ফেসবুক না ব্লগস্পট, ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগের মতো জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোতে ফ্রি ব্লগ খুলে প্রতিদিন আপডেট করা হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের ছবি, মোবাইল নাম্বার। সেকেন্ডেই লাখ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে একটি মেয়ের ছবি, মোবাইল নাম্বার।
সম্প্রতি শুরু হয়েছে প্রবাসীদের দেশে থাকা স্ত্রীদের নাম্বার নিয়ে নোংরামি। বেশ কিছু সাইটে দেখা গিয়েছে আমার স্বামী অমুক দেশে থাকে/স্বামী প্রবাসী আমি একা/আমার সঙ্গে সারারাত থাকতে চাও তো এক্ষুনি কল দাও ইত্যাদি সব নোংরামি।
যে ভুলগুলো করছে মেয়েরা :
অনেক মেয়েই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট করার সময় মোবাইল নাম্বার ভেরিফেকশন করতে ব্যবহৃত নাম্বারটি প্রাইভেসি সেটিংসে ‘অনলি মি’ করে রাখতে ভুলে যায়। অনেকেই অপশন না জানার অজ্ঞতা থেকে নাম্বারটি পাবলিক অপশনে রেখে দিচ্ছে। এতে খুব সহজেই বিকৃত মানসিকতার অসভ্যরা নাম্বারগুলো পেয়ে যাচ্ছে।
ফেসবুকে মেয়েরা ব্যক্তিগত ছবি আপলোড করে ‘পাবলিক’ অপশন খোলা রেখে। অর্থাৎ যে কেউ ছবি দেখতে পারবে। আর যাকে তাকে ফ্রেন্ড লিস্টে যোগ করাও একটা বড় ভুল।
প্রতিকারের উপায় কি?
অসভ্য নোংরামি যেভাবে বেড়ে চলছে তাতে প্রতিকারের উপায় কি হতে পারে জানতে চাওয়া হলে আইটি ফার্মে চাকরি করেন রুবেল নামের একজন শীর্ষ নিউজকে বলেন, খুব সহজেই ফেসবুকে, ব্লগ স্পটগুলোতে অ্যাকাউন্ট করা যায়। প্রতিদিন হাজার হাজার ফেইক অ্যাকাউন্ট হচ্ছে। সচেতনতা ছাড়া বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পারভীনের মতে,আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক শিক্ষার ভীত এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে অল্পতেই তরুণরা হিংসাত্মক হয়ে যাচ্ছে। এই হিংসাত্মক মনোভাবের কারণে ভেতরে জেগে উঠা অবসাদ, মানসিক যন্ত্রণা প্রতিশোধের নানা উপায় খুঁজে তরুণ-যুবকরা। যা ইন্টারনেটে খুব সহজেই মেটাতে পারছে। মা-বাবা যদি সন্তানকে ছোট বেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলে তাহলে এসব অপরাধ কমে যাবে।