লিওনেল মেসি কাঁদছেন। দুর্লভ ছবি! নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পেনাল্টি শুট আউটে জয়ের পর কেঁদেছেন বিশ্বসেরা ফুটবলার। ম্যাক্স রদ্রিগেজের শটটি ডাচদের জালে জড়ানোর পরপরই টেলিভিশন ক্যামেরা তাক করে মেসির দিকে। তখনই দেখা যায় আর্জেন্টাইন অধিনায়কের চোখের কোণে চিক চিক করছে অশ্রু। এ অশ্রু বেদনার নয়, আনন্দের। ওই গোলেই ১৯৯০ সালের পর আর্জেন্টিনা ফের ফাইনালে উঠলো বিশ্বকাপের। আগামী রবিবার কিংবদন্তি ‘মারাকানা’ স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা-জার্মানি। মুখোমুখি হবে মেসি-মুলার। দুই দল, দুই তারকার বিশ্বসেরা হওয়ার লড়াইয়ে আড়ালে রয়েছে আরও একটি লড়াই। ইউরোপের আমেরিকা জয়! আগের ১৯ বিশ্বকাপ আসরে যা অধরা ছিল, এবার সেই শৃঙ্খল কি ভাঙতে পারবে জার্মানি, না আমেরিকা অজেয়ই থাকবে ইউরোপীয়ানদের কাছে? অপেক্ষায় থাকতে হবে ১৩ জুলাই পর্যন্ত।
১৯৩০ সালে শুরু। এবার বিশ্বকাপের ২০ নম্বর। ৮৪ বছরে পাঁচটি মহাদেশে বসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞ। ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান এবং ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া বাকি আসরগুলো বসেছে ইউরো ও ল্যাটিন আমেরিকায়। যার সাতবার আয়োজক ল্যাটিন দেশগুলো। ব্রাজিল (১৯৫০, ২০১৪) ও মেক্সিকো (১৯৭০, ১৯৮৬) দুইবার করে আয়োজক আসরের। এছাড়া উরুগুয়ে (১৯৩০), চিলি (১৯৬২) ও আর্জেন্টিনায় (১৯৭৮) বসেছে একবার করে। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো দুই মহাদেশের বাইরে বসে ফুটবল মহাযজ্ঞ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসা ওই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। মহাদশের বাইরে প্রথম ল্যাটিন দল হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিল, ১৯৫৮ সালে সুইডেনে। ইউরোপে শিরোপা জেতার যেমন রেকর্ড রয়েছে ল্যাটিন দলগুলোর। কিন্তু সেই রেকর্ড নেই ইউরোপীয় দলগুলোর। এবার সুযোগ এসেছে। এজন্য জার্মানিকে হারাতে হবে টগবগে ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকা আর্জেন্টিনাকে। পারবে কি?
প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ১৩ দেশ। ফাইনাল খেলেছিল স্বাগতিক উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। ওই আসরে চতুর্থ হয়েছিল যুগোস্লাভিয়া। পরের দুই আসরের আয়োজক ছিল ইতালি ও ফ্রান্স। ১৯৫০ সালে আবার বিশ্বকাপ ফিরে আসে ল্যাটিন আমেরিকায়। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ইউরোপীয় দলগুলোর সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ছিল চতুর্থ। ১৯৬২ সালে চিলি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। এবারই প্রথম ফাইনালে উঠে কোনো ইউরোপীয় দল। ব্রাজিলের কাছে ১-৩ গোলে হেরে যায় চেকোস্লাভাকিয়া। শিরোপা কাছাকাছি ওই প্রথম আসা কোনো ইউরোপীয় দলের। ১৯৭০ সালে মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল-ইতালি। জুলেরিমে ট্রফি চিরতরে করে নেওয়ার লড়াই ছিল ফাইনালটি। এমন সমীকরণের ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারায় ব্রাজিল। এরপর ১৯৭৮ সালে ঘরের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে হারায় টোটাল ‘ফুটবলের জনক’ নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ আবারও ফিরে আসে মেক্সিকোতে। এবারও চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। দিয়াগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে আলবেসিলেস্তারা ৩-২ গোলে হারায় জার্মানিতে। এরপর ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বসেনি ল্যাটিন আমেরিকায়। ২৮ বছর আবারও ফিরে আসে ল্যাটিন আমেরিকায়। আবারও ফিরে আসে ব্রাজিলে। এরমধ্যে ১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ২০০২ সালে জাপান-দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগের ১৯ আসরে ইউরোপীয় দলগুলো যে কয়বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তার সবগুলোই ছিল ইউরোপের পরিচিত কন্ডিশন বা আফ্রিকায়। সুতরাং এবার যদি জার্মানি জিতে যায় বিশ্বকাপ, তাহলে রচিত হবে নতুন ইতিহাস। বিশ্বকাপের ইউরোপীয় ঝাণ্ডা উড়বে ল্যাটিন আমেরিকায়। ষোল শতকে যা করেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।