ঈদকে সামনে রেখে শ্যাম্পু, বডি স্প্রে, স্নো-পাউডার থেকে শুরু করে সাবান, শেভিং ক্রিম, নেইল পলিশ, লিপস্টিক, মেহেদি, তেল ও মেকআপসহ সব ধরনরে প্রসাধনীরই নকল হচ্ছে। ব্র্যান্ডের প্রসাধনীই বেশি নকল হচ্ছে। আর এসব প্রসাধনী কিনে মানুষ শুধু প্রতারিতই হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে।
ফুটপাথ থেকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সব খানেই বিস্তার নকল প্রসাধন সামগ্রীর। দেখলে কারো বোঝার উপায় নেই যে এগুলো নকল। সবই নামি-দামি ব্রান্ডের। কিন্তু বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর মাথায় হাতদেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। বিদেশী নামি-দামি ব্রান্ডের কসমেটিকস মিলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসে। এসব পণ্যেও রয়েছে ভেজাল। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নকল প্রসাধনী ব্যবহারে চর্মরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্ধকার ও খুপড়ি ঘরে তৈরি করা হয় নকল প্রসাধনী। যা চকবাজারের পাইকারি বাজার থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। অবশ্য রমাজানের শুরু থেকেই এসব নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু নকল প্রসাধনী পণ্য তৈরিতে একেরপর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে নকল প্রসাধনীতে।
গত সোমবার দুপুরে পুরান ঢাকার বংশালে অভিযান চালিয়ে নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির ১৮টি কারখানা ও গুদাম সিলগালা করে দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র্যাব সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ নকল প্রসাধন সামগ্রী ও তৈরির যন্ত্রপাতির জব্দ করে। এ ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত আনোয়ার হাওলাদার ও ছানোয়ার হাওলাদার নামের দুই সহোদরকে গ্রেপ্তার করে ২ বছরের জেল ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইচএমআনোয়ার পাশা জানান, নর্থ সাউথ রোডে বংশাল থানার পেছনে মালিটোলার ময়না হাজীরবাড়ি এবং আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে গড়ে উঠেছিল নকল প্রসাধন সামগ্রীর কারখানা। শ্যাম্পু, বডি স্প্রে, চুলের তেল, বডি লোশন, ক্রিমসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহৃত কন্টেইনার সংগ্রহ করে তাতে ইচ্ছা মতো উপাদান ভরে বাজারজাত করতো এই অসাধু ব্যবসায়ীরা। আসল মোড়ক ও প্রায় হুবহু রঙ-সুগন্ধি ব্যবহারেরকারণে সাধারণ ক্রেতার কাছে তা বোঝাও মুশকিল খাঁটি না নকল পণ্যটি।
তিনি জানান, গোপন খবরের ভিত্তিতে সোমবার দুপুরে মালিটোলার ১৫ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় নকল প্রসাধন কারখানার দুই মালিক আনোয়ার হাওলাদার ও ছানোয়ার হাওলাদারকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারখানা ও গুদামগুলো সিলগালা করে দেয়া হয়।
দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ছানোয়ার জানান, ১৯৯১ সাল থেকে তারা ফেরিওয়ালা হিসেবে কাগজ ও প্রসাধন সামগ্রীর খালি কন্টেইনার কিনতেন।প্রায় এক যুগ আগে তারা শুধু প্রসাধন সামগ্রীর কন্টেইনার কেনাবেচার পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তারা নকল প্রসাধন তৈরির পরিকল্পনা করেন। তারা ময়না হাজীর বাড়ির দোতলা-নিচতলা ও পাশের কয়েকটি বাড়িতে কারখানা ও গুদাম তৈরি করেন। এসব স্থানে মজুদ করা হয় বিপুল পরিমাণ খালি বোতল, কৌটা, কাগজের মোড়ক, লেবেল, হলোগ্রাম স্টিকার ও কাঁচামাল। কোনো রকম অনুমোদন ও বৈধ প্রক্রিয়াছাড়াই নিজেরাই তরল সাবান, স্পিরিট, সুগন্ধি ইত্যাদি দিয়ে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, লোশন, সুগন্ধি ও বডি স্প্রে তৈরি করা শুরু করে। সেগুলো ব্যবহৃত আসল কন্টেইনারে ভরে বাজারজাত করা হতো। এর মধ্যে ছিল প্যান্টিন, ডাভ, হেডঅ্যান্ড শোল্ডার, সানসিল্ক ও কিয়ার ব্রান্ডের শ্যাম্পু এবং মেক্সি, এক্স, হ্যাভক, ব্রুট ও ডয়েট ব্রান্ডে বডি স্প্রে ও লোশন।
নকল প্রসাধন কারখানার কর্মচারী মশিউর জানান, ব্যবহৃত বোতল ও কৌটা ভালোভাবে পরিষ্কার করেতাতে নতুন লেবেল ও হলোগ্রাম লাগিয়ে নতুনের মতো করা হতো। পরে ইনজেকশন সিরিঞ্জের সাহায্যে নকল শ্যাম্পু বা লোশনের তরল ভেতরে ঢোকানো হতো। দেখতে আসলের মতো হওয়ায় এবং নির্ধারিত ব্রান্ডের অনুরূপ সুগন্ধি ব্যবহারের কারণে ব্যবহারকারী আসল-নকলের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারতেন না। সাধারণ বিপনি বিতানতো বটেই, অনেক নামকরা শপিং মলেও এসব পণ্য বিক্রি হয় বলে তার দাবি।
মালিটোলায় কামাল উদ্দিন নামের আরেক কর্মী জানান, এই এলাকায় অনেক ভেজাল পণ্য তৈরির কারখানা রয়েছে। আর এগুলো সাধারণত অন্ধকার ও খুপড়ি ঘর দেখে বেছে নেয়া হয়। যেখানে লোকজনের চলাচল কম থাকে। এসব কারখানায় কোনো পরীক্ষাগার বা বিশেষজ্ঞ ছাড়াই তৈরি হচ্ছে শীতের প্রয়োজনীয় সব প্রসাধনী। শুধু রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় দু’শতাধিক নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে।
চকবাজার সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ ওইসব কারখানা থেকে পণ্য এনে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন হাত ঘুরে নকল প্রসাধনী দেশের বড় সুপার শপ, বিপণি বিতান, শহরতলি ও গ্রামে যাচ্ছে। ছোট ছোট দোকানগুলোতে এসব পণ্য অনেকে নকল মনে করলেও বড় বড় শপিংমলগুলোতে অনায়াসেই নকল পণ্যগুলো কিনে ঠকছে ক্রেতা। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন এসব পণ্য কিনে।
নগরীর প্রসাধন সামগ্রীর পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যাল থেকে শুরু করে বিদেশ থেকে আমদানি করা নামকরা ব্র্যান্ডের পণ্য অবলীলায় নকল হচ্ছে। এছাড়াও জনসন লোশন, মেরিল লোশন, ভ্যাসলিন, নিভিয়া লোশন, ডাভ লোশন, লাক্স লোশন, মাস্ক লোশন, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি বডি লোশন, পন্ডস বডি লোশন, সানস্ক্রিন লোশন, কোল্ড ক্রিম, ফেড আউট ক্রিম, ওলে ক্রিম, গার্নিয়ার লোশনের নকলে সয়লাব বাজার।
র্যাব সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা থেকে বিভিন্ন পারফিউমারি দোকান থেকে কেমিক্যাল সংগ্রহ করে এসব প্রসাধনী তৈরী হচ্ছে। শ্যাম্পু তৈরিতে ব্যবহার হয় সাবান পানি, কেমিক্যাল ও পারফিউম। বিভিন্ন সাবান কারখানা থেকে উচ্ছিষ্ট বা নিম্নমানের সাবান পানি সংগ্রহ করে পারফিউমের সাথে মিশিয়ে শ্যাম্পু তৈরী করা হয়। পরে নামি-দামি ব্রান্ডের শ্যাম্পুর খালি বোতল সংগ্রহ করে অথবা নামি-দামি ব্রান্ডের লেবেল লাগিয়ে বোতলজাত করে বাজারে ছাড়া হয়।
এছাড়া নামি-দামি ব্রান্ডের মেয়াদউত্তীর্ণ শ্যাম্পু সংগ্রহ করে তাতে আরো সাবান পানি এবং কেমিক্যাল মিশিয়ে শ্যাম্পু তৈরি করা হচ্ছে। যা এগুলো দেখে কারো বোঝার উপায় থাকে না এটি আসল নাকি নকল। একইভাবে স্পিরিট ও সুগন্ধী কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরী হচ্ছে পারফিউম। যা পরে বিশেষ কায়দায় নামি-দামি ব্রান্ডের বোতলজাত করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। সুগন্ধী তেল, সেভিং লোসন তৈরিতেও একই পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকার লছমানগঞ্জ, বুড়িশুর, মান্দাইল, কালিন্দি এলাকায় শতাধিক নকল কসমেটিকস কারখানা রয়েছে। অপরদিকে পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলবীবাজার, বড়কাটরা, সদরঘাট, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, রহমতগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, ইসলামবাগ, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, সূত্রাপুর, পোস্তগোলা, ধোলাইখাল, ফরিদাবাদ, ইসলামপুর, সোয়ারীঘাট, দেবীদাস লেন, কামালবাগ, শহীদনগর, টঙ্গীসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের পাগলার বেশ কয়েকটি জায়গায় নকল প্রসাধন তৈরির গুদাম ও কারখানা রয়েছে।
পুরান ঢাকার চকবাজার, মরিয়ম প্লাজা, আফতাব, মনসুন খান প্লাজা, তাজমহল মার্কেটসহ অন্যান্য জায়গায় নকল প্রসাধনী বিক্রি হয়। এছাড়া গুলিস্তান, স্টেডিয়াম মার্কেট, যাত্রাবাড়ি, নিউমার্কেট, মহাখালী, গুলশান, মিরপুর বিপণি বিতান ও ফুটপাতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে নকল প্রসাধনী। বিভিন্ন মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ফেরিওয়ালারাও বিক্রি করছেন এসব নকল পণ্য।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন,“বিশ্ব মানের প্রসাধন সামগ্রীকে অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেভেল লাগিয়ে জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা। এরা ক্ষতিকর কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে এসব নকল প্রসাধনী তৈরি করছে। এতে মানুষ শুধু প্রতারণারই শিকার হচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে। রমজানে বেশ কিছু ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে।”
ভোক্তার অধিকার রক্ষায় এবং জননিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান উইংকমান্ডার হাবিবুর রহমান।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, নকল প্রসাধন সামগ্রীতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার হচ্ছে, তা মাত্রাতিরিক্ত এবং কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া। ফলে এসব ব্যবহারের ফলে এলার্জি, ক্ষত, কিলয়েড (চামড়া কালো হয়ে যাওয়া), একজিমায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমনকি দীর্ঘদিন নকল কসমেটিক ব্যবহারের ফলে স্কিন ক্যান্সারের মতো ঝুঁকিও রয়েছে।