প্রায় ৩ বছর ধরে গার্মেন্টের ঝুটের ব্যবসা করতেন মাহাবুবুর রহমান সুজন। স্থানীয় এক সন্ত্রাসীর সহযোগী মোহন তার কাছে ঝুটের মালামাল কেনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, তিনি রাজি হননি। মোহনের বন্ধু ছিলেন মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমান। ঝুটের ব্যবসা অবৈধ বলে এসআই জাহিদুর তার কাছে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। চাঁদা না দিলে তাকে বিভিন্ন স্থানে শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানি করতেন। এসআই জাহিদুরের অত্যাচারের কারণে সুজন ইউরোপের একটি দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গতকাল এমনই অভিযোগ করেছেন নিহতের ভাই নজরুল ইসলাম শামীম। শনিবার রাতে মিরপুর থানায় পুলিশের হেফাজতে ঝুট ব্যবসায়ী সুজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ করে তার পরিবার। তবে পুলিশের দাবি, নিহত যুবক শাহআলী এলাকার শীর্ষ ছিনতাইকারী। এদিকে, মিরপুর অঞ্চলে এসআই জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার সব অপকর্মে মিরপুর অঞ্চলের পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তার মদত আছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
গতকাল দুপুরে নিহত সুজনের নিজ বাড়ি শাহআলী থানাধীন ই-ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর প্লটে গিয়ে দেখা যায়, তার হত্যার প্রতিবাদে দুইটি কালো ব্যানার টানানো হয়েছে। ওই বাড়িটির সামনে এলাকাবাসী ভিড় করছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে যে, তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে ওই তদন্ত কমিটির প্রধান মিরপুর অঞ্চলের পুলিশের এডিসি জসীম উদ্দীনের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা এলাকাবাসীর কাছে তথ্য সংগ্রহ করছেন। পুলিশের উপস্থিতিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং অবিলম্বে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এসআই জাহিদকে চাকরিচ্যুত ও বিচার দাবি করেন। এ বিষয়ে নিহতের বড় ভাই নজরুল ইসলাম শামীম জানান, ‘দীর্ঘ ৩ বছর ধরে এসআই জাহিদুর রহমান আমার ভাই সুজনের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। কারণ একটাই, সে ঝুটের ব্যবসা করে। সে তার কাছে চাঁদা চায়। কিন্তু, তার ভাইয়ের দাবি, ঝুটের ব্যবসা তো অবৈধ নয়। কেন চাঁদা দিতে হবে? তিনি আরও বলেন, সুজন শাহআলী এলাকার প্রায় ৭টি গার্মেন্টসের ঝুটের মালামাল ক্রয় করতো। প্রতিমাসে প্রায় ১ লাখ টাকা করে চাঁদা দিতো এসআই জাহিদুরকে। চাঁদা না দিলে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিতো। প্রায় ৬ মাস আগে দুপুরে তার ছোট ভাই জহরুল ইসলাম সবুজ বাসায় অসুস্থ অবস্থায় ঘুমিয়েছিল। তখন এসআই জাহিদুর বাসায় এসে তার ভাইয়ের বিছানার পাশে রিভলবার রেখে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক করে আটক করে নিয়ে যায়। সবুজ এখনও কাশিমপুর কারাগারে আছে। এসব ঘটনা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানিয়ে কোন লাভ হয়নি বরং হয়রানির হুমকি দেয়া হয়েছে। শামীম বলেন, এসআই জাহিদুরের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য সুজন ইউরোপের যে কোন একটি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এক মাস আগে পাসপোর্ট তুলেছিল এবং কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তার আগে পুলিশ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করলো বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের মোবাইলে ফোনে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও পুলিশের নাম করে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। নিহতের খালু জুলহাস আলী জানান, সুজনের নিহতের ঘটনায় পুরো শাহআলীর এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত ও আতঙ্কিত। আজকে আমার এক স্বজনকে পুলিশ এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কালকে যে অন্য কারও করবে না তার কি কেউ নিশ্চিয়তা দিতে পারবে? এমন একটি ঘটনার পর ওই পুলিশ কর্মকর্তা তার পদে কিভাবে বহাল থাকে তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেন।
এ ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান ও পুলিশের মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জসিম উদ্দীন জানান, আমরা গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী ও পরিবারের বক্তব্য নিয়েছি। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি, আগামী সাতদিনের মধ্যে এই তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারব। তিনি আরও বলেন, নিহতের ঘটনায় পুলিশের কোন গাফলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এসআই জাহিদুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে। কোন ছাড় দেয়া হবে না। নিহতের পরিবারের মামলা নেয়া হচ্ছে না কেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর নিহতের পরিবারের মামলা নেয়া হবে।
এসআই জাহিদুরের যত অপকর্ম: এসআই জাহিদুর রহমানের নামে মিরপুর এলাকায় সরজমিনে বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে মিরপুরের কাফরুল, পল্লবী, শাহআলী ও মিরপুর থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণে পুরো মিরপুরের সব বিষয় ছিল তার নখদর্পণে। পল্লবীতে চাঁদার টাকা না দেয়ায় জনি নামে এক বিহারি যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে তদবির করে তিনি আবার শাহআলী থানায় দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তখন থেকেই এই তিনি আসকারা পেয়ে যান। শাহআলী এলাকায় রিপন নামে চা দোকানিকে তার সোর্স দিয়ে চোর সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। পল্লবী এলাকায় কাঁচামাল ব্যবসায়ী কালু নামে এক যুবককে রাতের আঁধারে তিনি আটক করেছিলেন। পরে থানায় নিয়ে গিয়ে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদার টাকা না দেয়ায় তার পায়ে রড ঢুকিয়ে নির্যাতন করেন। কালুর ভাই দেলোয়ার জানায়, তার ভাই এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। শাহআলীর দিয়াবাড়ির বাসিন্দা মামুন জানান, প্রায় ৭ মাস আগে রাত ১২টার সময় মিরপুরের কাজী পাড়ার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে আসছিলাম। তখন এসআই জাহিদুর আমাকে সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। থানায় নিয়ে গিয়ে আমার কাছে ৩০ হাজাট টাকা চাঁদা দাবি করেন। না হলে ছিনতাইয়ের মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন। হয়রানির ভয়ে আমার পরিবার অন্য একজনের কাছ থেকে ধার করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ওই রাতেই আমাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনে। সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে ২৪শে সেপ্টেম্বর পুলিশের এএসআই পদে যোগ দেন জাহিদ। মাদারিপুর সরকারি কলেজে অনার্স পড়াকালে ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন তিনি।