তিন টনের একটি পিকআপের কাঠামো বা বডি তৈরি হচ্ছে যশোরের মুড়লী এলাকার একটি কারখানায়।কাজ করছে দুই শিশুসহ তিন শ্রমিক।পাশে দাঁড়িয়ে সেই কাজের তদারকি করছেন ট্রাকের মালিক পটুয়াখালীর মেহেদি হাসান। কাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ, বািক শুধু রঙের কাজ। তারপরই পণ্য পরিবহনের জন্য চকচকে নতুন গািড় নিয়ে ছুটে যাবেন নিজের জেলায়।
মেহেদি হাসানের বক্তব্য, ‘বরিশাল বিভাগে গািড়র কাঠামো তৈরির কোনো কারখানা নেই। ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে আছে, তবে সেখানে খরচ বেশি। তা ছাড়া এখানে কাজের মানও ভালো।’ জানালেন, ভারত থেকে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে পিকাপের চেসিস আমদানি করে এনেছেন। গািড়র কাঠামো তৈরি করতে সব মিলিয়ে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগছে। এর মধ্যে শুধু মজুরি ২০ হাজার টাকা। তবে যশোর ছাড়া অন্য জায়গায় করালে মজুরি ৪০ হাজার টাকার নিচে কাজটি করানো সম্ভব নয়।
পটুয়াখালীর এই মেহেদি হাসানের মতো সারা দেশের অনেক পরিবহন ব্যবসায়ীর আস্থার কারণেই যশোরের মুড়লী ও বকচর এলাকায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের ট্রাকের কাঠামো তৈরির কারখানা। মূলত বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন আসা সারি সারি ভারতীয় ট্রাকের চেসিসের (গাড়ির ইঞ্জিনসহ মূল কাঠামো) একটি অংশ চলে আসে এসব কারখানার ছাদের নিচে। সেখানেই দেশীয় উপকরণ আর দক্ষ শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় যানগুলোর শরীরে উঠছে চকচকে কাঠামো। তারপর পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে ট্রাকগুলো পণ্য পরিবহনের জন্য পাড়ি দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
যশোরের অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতি বলছে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে তিন হাজারের মতো কারখানার আছে। এগুলোতে কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। এর মধ্যে সমিতির সদস্যসংখ্যা এক হাজার। আর ট্রাকের পাশাপাশি বাসের কাঠামো তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা ৪০টি। প্রতিবছর এসব কারখানা থেকে কয়েক শ গাড়ির কাঠামো তৈরি হয়। কাঠামো তৈরির পাশাপাশি বাস-ট্রাকের ছোট-বড় সব ধরনের মেরামতের কাজ করে এই কারখানাগুলো।
অবশ্য একাধিক কারখানার মালিক জানালেন, গত দু-তিন বছর গাড়ির কাঠামো তৈরির কাজটি কিছুটা কম হচ্ছে। কারণ, আমদানি কমেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাই এর বড় কারণ। তবে সম্প্রতি এটি আবার বাড়ছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষও সে রকমই তথ্য দিচ্ছে। ২০১১–১২ অর্থবছর ১২২ কোটি টাকার এক হাজার ১১২টি ট্রাকের চেসিস আমদানি হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সেটি কমে ৬৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ৫৯৯ পিসে নেমে যায়। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) প্রথম নয় মাসে ৪১ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৩৯০ পিস চেসিস আমদানি হয়। তবে শুধু গত ৩০ জুন ১২৭টি চেসিস এসেছে।
মুড়লী এলাকায় সাত বছর আগে ‘বাংলাদেশ বডি বিল্ডার্স’ নামে একটি কারখানা করেছেন রবীন সেন। বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরি তাঁর এই কারখানায় কাজ করেন সাতজন শ্রমিক। প্রতি দুই মাসে তাঁরা তিন থেকে চারটি ট্রাকের কাঠামো তৈরি করতে পারেন। একই সঙ্গে এখানে হয় পুরোনো গাড়ির মেরামত।
৩ জুলাই গিয়ে দেখা যায়, রবিনের কারখানায় চারটি ট্রাকের কাঠামো তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। তদারকি করছেন রবিন নিজেই। জানালেন, ১০ চাকার ট্রাকের কাঠামো তৈরিতে পাঁচ লাখ এবং ছয় চাকার ট্রাকের কাঠামো তৈরিতে চার লাখ টাকা লাগে। এর মধ্যে শুধু মজুরি বাবদ ১০ চাকায় ৪০ হাজার আর ছয় চাকায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পায় এসব কারখানা।
বাকি অর্থ কিসে ব্যয় হয়, জানতে চাইলে রবিন সেন বলেন, ট্রাকের কাঠামো তৈরিতে বডি, ওয়েল্ডিং, ইঞ্জিন, রং ও কাঠমিস্ত্রিও প্রয়োজন হয়। তবে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ইস্পাত ক্রয়ে। তা ছাড়া কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি হলে সে ক্ষেত্রেও খরচ বেশি লাগে।
রবিনের কারখানার উল্টো পাশেই মুরারী অধিকারীর কারখানা। সেখানেই পটুয়াখালীর মেহেদি হাসান নিজের ট্রাকের কাঠামো তৈরি করছিলেন। মুরারী জানালেন যে তিনি ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে এ কাজ করেন। আগে অন্য জায়গায় কাজ করলেও ছয়-সাত বছর আগে তিন বন্ধু মিলে এই কারখানাটি দিয়েছেন। তাঁরা ছাড়া এতে কাজ করেন দুই শিশু। ট্রাকের কাঠামো তৈরির কাজ না থাকলে পুরোনো গাড়ি মেরামতের করেন বলে জানালেন তিনি।
মুরারীর কারখানায় কাজ করে ১২ বছর বয়সী রশীদ বিশ্বাস। আমরা যখন কারখানায় যাই, রশীদ তখন নতুন গাড়ির কাজে ব্যস্ত। ছোট ছোট লোহার টুকরা ভারী হাতুিড় দিয়ে সোজা করছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এ কাজে কেন এসেছ—প্রশ্ন করলে রশীদ জানায়, তার বাবা মো. খোকন ভ্যানচালক। ঘরে তিন বোন আর মা। সংসার চলে না বলে সাত মাস আগে এ কাজে আসে রশীদ। সহকারীর কাজ করে সপ্তাহে সে পায় ৯০০ টাকা।
জানা গেল, এখানকার শ্রমিকদের কারোরই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। শিশু বয়স থেকে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় তাঁরা কারিগর হয়ে যান। আর এ জন্য দক্ষতাও কম। বর্তমানে চার-পাঁচজন শ্রমিক মিলে মাসে একটি ট্রাকের কাঠামো তৈরি করতে পারেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেলে এই শ্রমিকেরাই মাসে দুই থেকে তিনটি করতে পারতেন বলে জানালেন সমিতির নেতারা।
এ ছাড়া এসব কারখানার প্রায় সব কটিতেই শিশুশ্রম হচ্ছে। মূলত অভাবের তাড়নায় আসে শিশুরা। তবে তাদের শিক্ষিত করার জন্য কোনো নৈশ স্কুল নেই। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে শিশুদের পাশাপাশি বড়দের নিরাপত্তার বিষয়ে নেই কোনো সচেতনতা।
বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহিন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানাগুলো আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যশোরে একটি আলাদা অটোমাবাইল শিল্পাঞ্চল স্থাপনের জন্য সমিতির পক্ষ থেকে বিসিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।’
কারখানায় শিশুশ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহিন কবির বলেন, ‘এখানকার শ্রমিকদের কারোরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। শিশু বয়স থেকে হাতুড়ি পেটাতে পেটাতে সবাই বড় মিস্ত্রি হয়। দরিদ্রতার কারণেই শিশুরা এ কাজে আসে। তাদের আমরা বাদ দিতে পারব না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে হাসপাতাল-ক্লিনিকে নেওয়া হয়। ওয়ার্কশপ থেকে তার চিকিৎসার খরচ বহন করা হয়ে থাকে।’
শিগগিরই যশোরে অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল ও অটোমাবাইল প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের দাবি করেন শাহিন কবির। তিনি বলেন, এগুলো হলে প্রতিবছর আরও সুচারু ও বেশি কাঠামো তৈরি করা যাবে। এ ছাড়া মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) যশোর কার্যালয়ের শিল্পনগর কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘অটোমোবাইলের জন্য আলাদা শিল্পনগর করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ তবে তিনি জানান, ২০০৪ সালে বিসিকের প্রধান কার্যালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।