রাজধানীর বনানী কবরস্থানে স্বামী মো. হাসান আলীর পাশেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত হলেন সাংবাদিক ও সাবেক সংসদ সদস্য বেবী মওদুদ।
শুক্রবার রাত ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তৃতীয় জানাজা শেষে তার মরদেহ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এসময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মরহুমার মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বেবী মওদুদের ভাতিজা মনোয়ার হোসেন জানান, জানাজা শেষে বেবী মওদুদের মরদেহ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই শেষে শুক্রবার রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বেবী মওদুদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
শুক্রবার এশার নামাজের পর ধানমণ্ডির ঈদগাহ মাঠে মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় প্রেসক্লাবে। সেখানে সাংবাদিক, গুণীজনসহ সর্বস্তরের মানুষ তার মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবে বেবী মওদুদের মরদেহের প্রতি অন্যান্যের মধ্যে শেষ শ্রদ্ধা জানান- জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের পক্ষে জাহাঙ্গীর কবির নানক, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ার, ছাত্রীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহগ।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিকদের ইউনিয়নের একাংশ, বেবী মওদুদের সাবেক কর্মস্থল সংবাদ পরিবার, পার্লামেন্ট সাংবাদিক ইউনিয়ন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এদিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাজার আগে বেবী মওদুদের বাসস্থান ধানমন্ডি ১০/এ ও পরে ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠে দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জানাজার পূর্বে বেবী মওদুদের বড় ছেলে অভি তার মায়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সবার কাছে দোয়া চান। আগামী ১দ আগস্ট ধানমণ্ডিতে তার কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি জানান।
বেবী মওদুদ বর্ণাঢ্যময় ৬৬ বছরের জীবনে একাধারে সিদ্ধহস্তে যেমনি করেছেন সাংবাদিকতা, তেমনি করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্যাঙ্গনে বিচরণও তার কম কম ছিল না।
বিশিষ্ট সংবাদিক ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আফরোজা নাহার মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন, কলকাতায়। তার বাবা আবদুল মওদুদ ছিলেন একজন বিচারপতি। আর মায়ের নাম হেদায়েতুন নেসা। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। আনুষ্ঠানিক নাম এ এন মাহফুজা খাতুন হলেও সবাই তাকে চিনতেন ‘বেবী মওদুদ’ নামে। নিরংহকারী, পরোপকারী, সাদামাটা পোশাকের স্নেহময়ী এই নারী সহকর্মীদের সবার কাছে ছিলেন ‘বেবী আপা’।
বেবী মওদুদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন বেবী মওদুদ। ১৯৭১ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার আগে ১৯৬৭-৬৮ সময়ে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন বেবী মওদুদ। দৈনিক সংবাদ, বিবিসি, দৈনিক ইত্তেফাক, বাসস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রায় দীর্ঘদিন কাজ করার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগ দেন। অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে য্দ্ধুাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন বেবী মওদুদ। নবম জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখিতে যুক্ত ছিলেন তিনি।
বেবী মওদুদ শুধু রাজনীতি কিংবা সাংবাদিকতা নিয়েই পড়ে থাকেননি। তার বিচরণ ছিল সাহিত্যাঙ্গনেও। সাংবাদিকতা ও রাজনীতির ফাঁকে তার প্রকাশিত লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে- মনে মনে (ছোট গল্প), দুঃখ-কষ্ট-ভালোবাসা (উপন্যাস), নারী ভুবন (কলাম), অন্তরে বাহিরে (কলাম), পাকিস্তানে বাংলাদেশের নারী পাচার, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের নারী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, নিভৃত যতনে, রোকেয়া টাফ, আমার রোকেয়া, চিরন্তন প্রতিকৃতি রোকেয়া, শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, সষি পুষি টুষি (ছড়া), দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, শান্তর আনন্দ, এক যে ছিল আনু, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, কিশোর সাহিত্য সমগ্র ও আবু আর বাবু।