প্রকৃতির সবুজ ‘রাজকন্যা’ মৌলভীবাজার। মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন চা বাগানগুলোর মনোহর দৃশ্য, হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ সফেদ জলরাশি, লাউয়াছড়ার দুর্লভ জীববৈচিত্র্য, দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড ও দুর্গম পাহাড়ের জলকন্যা হামহামসহ এ জনপদের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাজকন্যার সৌন্দর্যের পশরা। এবারের ঈদে এখানে বসেছে আনন্দের মেলা। এই মেলা হারিয়ে গেছে হাজারও মানুষ।
লাউয়াছড়া: রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিনোদনের অন্যতম এ স্পটটি দেশের বনাঞ্চলের মধ্যে নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়ায় দেখা মেলে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীর। ১৯২৫ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে তৈরি করা প্লান্টেশনই এখনকার ঘন অরণ্যের রূপ নিয়েছে। ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের একটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি হিসেবে টিকে আছে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বনকে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ। নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ বর্ষাবন বা রেইন ফরেস্টের মতো এখানেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই বনে।
হাকালুকি হাওর: প্রকৃতির এই বিশাল দুনিয়ায় কি নেই! নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ, পাখি, শাপলা-শালুক, ঝিনুক, শ’ শ’ প্রজাতির জলজ প্রাণী আর হিজল, কড়চ, বরুন, আড়ং, মূর্তা, কলুমসহ সবুজের ঢেউ জাগানিয়া মনকাড়া পরিবেশ। বর্ষা মওসুমে থৈ থৈ পানি আর শীত মওসুমে পাখির খেলা বিমোহিত রূপ মাধুর্যে কাছে টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের।
বৃহত্তম হাওর হাকালুকির সীমানা মৌলভীবাজার ছাড়িয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। ২৩৬টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪শ’ হেক্টর।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত: দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী বাজার থেকে ৪ কি.মি. পূর্ব দিকে এগোলেই কানে আসবে ক্রমাগত জল গড়ানোর শব্দ। সেই সঙ্গে থাকবে সবুজ চা পাতার তাজা গন্ধ। প্রায় ২০০ ফুট পাথারিয়া পাহাড়ের ওপর থেকে ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে আছড়ে পড়া জলরাশির ঝরনাধারার দৃশ্যে মন নাচে আনন্দ আবেগে।
দুর্গম হামহাম: গহীন অরণ্যের দুর্গম হামহাম জলপ্রপাত। ১৫০ ফুট পাহাড়ের ওপর হতে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানি আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। হামহাম জলপ্রপাত কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যে। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। এলাকার পশ্চিম দিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৯ কি.মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাত। প্রায় ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেটে পৌঁছাতে হয় এই ‘ঝরনা সুন্দরী’র আঙিনায়। নতুন সন্ধান পাওয়া রোমাঞ্চকর দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দিনদিন পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে।
মাধবপুর লেক: মাধবপুর লেক। নয়ন জুড়ানো এই লেক কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের পাদদেশে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি ও সমতল পথ পেরিয়ে চা বাগানের ভেতরে দেখা মিলে আকর্ষণীয় এই লেকের। ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন চা বাগানের ভেতরে মাধবপুর লেক নিজের রূপ দিয়েই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নয়ন কাড়ে।
এছাড়া জেলার ৯২টি মনোমুগ্ধকর চা বাগানসহ আছে কুলাউড়া উপজেলার টাটুরার বান্ধ (বাঁধ) লেক, লালমাটি টিলা, গগন টিলা (ওপেন ওয়াচ টাওয়ার), হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি বিজড়িত সিআরপি রেস্ট হাউস ও জুড়ী উপজেলার কমলা ও আনারসের বাগান।
যাতায়াত: ঢাকা থেকে ট্রেনে শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়া স্টেশনে নামতে হবে। বাসে আসলে শ্যামলী, রূপসী বাংলা, এনা, সাদ্দাম পরিবহনে এসে শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার ও কুলাউড়ায় নামতে পারেন। থাকার জন্য ফাইভ স্টার হোটেলসহ স্থানীয় উপজেলাগুলোতে হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টের ব্যবস্থা আছে।