ঘুম ভাঙ্গার পর আড়মোড়া ভেঙ্গে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। ভালো করে মুখের দিকে তাকাতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। ব্রণ উঠেছে! হায় হায় এখন কি উপায়! সামনেই বড় একটা অনুষ্ঠান। নখ দিয়ে খুঁটতে শুরু করলেন। যেন এখনি ব্রণটাকে নির্মূল করতে হবে। কিন্তু উল্টো জায়গাটাতে ক্ষত হয়ে গেল। ক্ষত সারাতে পাশের বাসার আন্টির পরামর্শমতো এটা সেটা লাগালেন। আর তাতেই বিগড়ে গেছে ব্রণ। পুরো গাল জুড়ে দগদগে ঘা। এরপর ডাক্তারের কাছে গেলেন চিকিৎসা নিতে কিন্তু ততদিনে মুখের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন। এই পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও খুব একটা লাভ পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রথমেই জানতে হবে ব্রণ যাতে না হয় সেই বিষয়গুলো। আর যদি ব্রণ হয়েই যায় তাহলে প্রাথমিকভাবে কি পদক্ষেপ নিতে হবে সেটাও জানা দরকার। ব্রণ/অ্যাকনের জীবাণুর নাম প্রোপাইনো যেটা বেশি পরিচিত ‘ব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনে’ নামে। সব বয়সীদের মধ্যেই ব্রণ প্রবণতা দেখা যায়, তবে বয়ঃসন্ধিকালে এর প্রকোপ দেখা যায়। বয়ঃসন্ধির সময় শরীরের অভ্যন্তরে নতুন কিছু হরমোনের নিঃসরণ হয়। নিঃসরিত এইসব হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ত্বকে তেলগ্রন্থি ও সেবাম ক্ষরণ বেড়ে যায়। এর ফলে রোমকূপগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে ত্বকে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আর এই বিষক্রিয়ার ফলেই ব্রণ/ অ্যাকনে সৃষ্টি হয়। মেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময় প্রথম ব্রণ দেখা যায়। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৬-১৯ বছর বয়সের মাঝে এবং মেয়েদের ১৪-১৬ বছর বয়সে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে ২০ বছর বয়সের পর থেকে ব্রণ হওয়ার হার কমে যেতে থাকে। যাদের ত্বক ব্রণপ্রবণ তাদের ৩০-৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ব্রণ হওয়ার প্রবণতা থাকে। ব্রণ সাধারণত মুখেই দেখা যায়, তবে পিঠে, ঘাড়ে এবং বুকেও হতে পারে। ব্রণের জীবাণুর সংক্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মৌসুমী আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। যেমন শীতকালের তুলনায় গরমকালে ব্রণের তীব্রতা বেশি থাকে। যেহেতু গরমকালে মুখ বেশি ঘামে আর বেশি ঘামলে সেবেশাস ও তেলগ্রন্থির নালি বন্ধ হয়ে ব্রণ হতে পারে। এছাড়া ত্বকে নানারকম কসমেটিকস্ এবং মেকাপ সামগ্রী ব্যবহারের কারণেও ব্রণের উৎপত্তি হতে পারে। আবার তেলতেলে চুল ও মাথার খুশকি থেকেও ব্রণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া মানসিক চাপ ও পর্যাপ্ত ঘুম না হলেও ত্বকে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাবের সাথেও ব্রণের সম্পর্ক রয়েছে।। ত্বকে ব্রণ একটি সাধারণ সমস্যা। তৈলাক্ত ত্বক তুলনামূলক বেশি ব্রণপ্রবণ হলেও অনেক সময় পেট পরিষ্কার না থাকলে হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে ব্রণ হয়। ত্বকের ধরন যাই হোক না কেন ব্রণ হওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে, ত্বকে ময়লা জমা। ব্রণের মতো বিপত্তি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনি নিজেই ব্রণকে প্রতিরোধ করতে পারেন। ব্রণ শুধু যে আপনার সৌন্দর্য নষ্ট করছে তা কিন্তু নয়, দীর্ঘদিন ব্রণের উপস্থিতির ফলে দাগগুলো স্থায়ী হয় এবং ত্বকে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। ব্রণ হলে আতঙ্কিত না হয়ে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ অবলম্বন করুন। দেখবেন ব্রণের প্রকোপ কমে যাবে। কি করবেন-
অ দিনে তিন-চারবার হালকা সাবান বা ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধোয়া উচিত।
অ দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হলে ব্যাগে গোলাপজল ও তুলার বল রাখুন। কয়েকবার তুলার বলে গোলাপজল লাগিয়ে মুখ পরিষ্কার করুন।
অ তেল ছাড়া অর্থাৎ ওয়াটার বেসড মেকআপ ব্যবহার করবেন।
অ মেকআপ না তুলে ঘুমাতে যাবেন না। তবে নিম সাবান দিয়ে মুখ ধুলে উপকার পাবেন।
অ ব্রণে হাত লাগাবেন না।
অ মাথা খুশকিমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
অ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং নিজের আলাদা তোয়ালে রাখুন।
অ রাতে ঠিকমতো ঘুমানোর চেষ্টা করবেন।
অ মানসিক চাপ পরিহার করুন।
অ ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পরিহার করুন।
অ প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি খান ও প্রচুর পানি পান করুন।
ব্রণ হলে কি করা উচিত নয়
অ ফেসিয়াল ম্যাসাজ করানো ঠিক না।
অ রোদে যাবেন না, তীব্র রোদ এড়িয়ে চলুন।
অ তেলযুক্ত ক্রিম বা ফাউন্ডেশন ব্যবহার করবেন না।
অ ব্রণে হাত লাগাবেন না। ব্রণ খুঁটবেন না।
অ চুলে এমনভাবে তেল দেবেন না যাতে মুখটাও তেলতেলে হয়ে যায়।
অ অতিরিক্ত তেল, ঘি, মসলা খাবেন না।
ব্রণের চিকিৎসা কখন প্রয়োজন
ব্রণ অনেক ধরনের হয়ে থাকে। কিছু ব্রণ আছে সেটা আপনাআপনি ত্বকের সাথে মিশে যায়। আবার কিছু কিছু ব্রণ আছে যেটা ত্বকের গভীরে পুঁজ সৃষ্টি করে। ব্রণ কয়েকদিন ধরে থাকলে খেয়াল করুন সেখানে পুঁজ তৈরি হচ্ছে কিনা। কিংবা ব্রণটির আশে পাশে আরো ব্রণ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা? ব্রণ বাড়তে থাকলে এবং বিস্তার ঘটতে থাকলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। চিকিৎসা না করালে অনেক সময় ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। ত্বকের গভীর প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। ব্রণ হলে সৌন্দর্যহানির কারণে অনেকের মধ্যেই হীনমন্যতা দেখা দেয়। তাই ব্রণ শুরুর সময়েই এর সঠিক চিকিৎসা দরকার। ব্রণের চিকিৎসার জন্য জার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হলে ভালো হয়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অন্যের কথা শুনে বা নিজের পছন্দসই কোনো ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক না। ব্রণের প্রকোপ কতখানি সেটা পরীক্ষা করে ডাক্তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। মনে রাখতে হবে ব্রণের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ তাই ভালো ফল পেতে আপনাকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে দীর্ঘসূত্রিতার অজুহাতে হঠাৎ চিকিৎসা পদ্ধতি বাতিল কিংবা ডাক্তার বদলানো ঠিক না।
ত্বক বুঝে পরিচর্যা করুন: ত্বকের ধরন বুঝে ব্রণের পরিচর্যা করা উচিত। সব ত্বকের সাথে সব ধরনের উপাদান যায় না। ব্রণের কারণে ত্বকের ক্ষত গভীর হলে কোনো রকম ম্যাসাজ করা ঠিক না। তবে ত্বক পরিষ্কার রাখলে ব্রণ পালাতে বাধ্য হবে।
ত্বক পরিচর্যার কিছু পদ্ধতি-
অ পুদিনা পাতা তৈলাক্ত ত্বকের জন্য খুব উপকারী। একমুঠো পুদিনা পাতা বেছে ধুয়ে পরিষ্কার করে এক কাপ পানিতে ফুটিয়ে আধ কাপ করুন। পানিটা ছেঁকে বোতলে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। বাইরে থেকে ফিরে এই পানির সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করে মুখে, গলায় ও হাতে লাগিয়ে ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বক পরিষ্কার হবে এবং তৈলাক্ততা দূর হবে। সাত দিন পর্যন্ত এই নির্যাস সংরক্ষণ করা যায়।
অ শুষ্ক ত্বকে পুদিনা পাতার নির্যাসটা বরফ কিউব করে নিন। এবার রুমালের ভেতর ওই বরফ কিউব ব্রণের ওপর আস্তে আস্তে চেপে ধরুন। এভাবে ১৫ মিনিট ত্বকে বরফ সেঁক দেবেন।
অ যাদের ত্বকে খুব বেশি ব্রণ তারা দুই-তিনটা লবঙ্গ ও ১ টেবিল চামচ মুগডাল ভিজিয়ে রেখে বেটে পেস্ট করে নিন। এরপর এবার ওই পেস্ট মুখে লাগান। এটা লাগানোর পর মুখ একটু জ্বলতে পারে। এতে চিন্তিত হবেন না। ১৫-২০ মিনিট পর কুসুম গরম পানির ঝাপটা দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
অ তৈলাক্ত ত্বকে অনেকেরই গুঁড়িগুঁড়ি ব্রণ হয়। এটা দূর করতে পুদিনা পাতার মতো একই পদ্ধতিতে নির্যাস তৈরি করে তার সঙ্গে ময়দা বা বেসন মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
অ ব্ল্যাক হেডস দূর করতে ১টা তেজপাতা, ১ টুকরা দারচিনি পেস্ট করে তার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে মুখে লাগান। নাকে ও থুতনিতে একটু ভালো করে ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন। এটা তৈলাক্ত ও শুষ্ক উভয়ের জন্যই উপকারী।
অ ব্রণের দাগ সারাতে দাগের ওপর জিরা পেস্ট করে তার সঙ্গে বেসন মিশিয়ে লাগান। ১৫-২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। দাগ সারাতে চন্দন পেস্টও খুব উপকারী।
অ ১ গ্লাস পানিতে ১টা তেজপাতা, ১ টুকরা দারচিনি ফুটিয়ে সেঁকে রাতে শোবার আগে খাবেন। পেট পরিষ্কার থাকবে। ব্রণ হবে না।
অ শাক-সবজি ও ফল খাওয়ার আগে পানির সাথে ১ টেবিল চামচ সিরকা মিশিয়ে ওই পানিতে ধুয়ে খান।
অ মুলতানি মাটি ও শঙ্খ গুঁড়া সমপরিমাণ নিয়ে সেঁকে একটা কৌটায় ভরে রাখুন। বাইরে যাওয়ার সময় পাউডার হিসেবে ব্যবহার করুন। ব্রণও হবে না সেইসাথে তৈলাক্ততাও দূর হবে।