‘মেঘের ওপর বাড়ি করব, যাতে কেউ আমাকে খুঁজে না পায়। আমাকে অশান্তিতে না রাখে। একা থাকব। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাব।’ নরসিংদীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার আগে এভাবেই ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখেছিলেন সোহানা আহমেদ (১৮)। সোহানা কি জানতেন, তার লেখার কথাগুলোর মতো মেঘের ওপর বাড়ি বাঁধতে হবে, তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না?
গত বুধবার নরসিংদীতে যাত্রীবাহী দুই বাসের সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে একজন সোহানা আহমেদ। তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের জসিম উদ্দিনের মেয়ে।
পুলিশ ও সোহানার পরিবারের লোকজন জানায়, সোহানার বাবা জসিম উদ্দিন পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে সোহানা ছোট। বড় ছেলে সাইফুল ইসলাম প্রবাসী। পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি ঢাকার মালিবাগে বসবাস করেন। প্রতিবছর জসিম উদ্দিন গ্রামের বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করলেও ব্যস্ততার কারণে এবার তা সম্ভব হয়নি। তাই ঈদের দুই দিন পর গত ৩১ আগস্ট সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে আসেন তাঁরা। পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে তাঁরা ঢাকায় রওনা দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তাঁরা সোহাগ পরিবহনের বাসে ওঠেন। সোহানা ও তাঁর মা আছিয়া বেগম গাড়ির চালকের পেছনের আসনে বসেন। তার পেছনে বসেন বাবা জসিম উদ্দিন ও দোকানের কর্মচারী লিটন মিয়া। তাঁদের বহনকারী বাসটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর শিবপুর এলাকায় মুখোমুখি সংঘর্ষে পতিত হয়।
দুর্ঘটনায় গাড়ি দুটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে চালকের পেছনে বসা মা-মেয়ে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। দুর্ঘটনার পর দোকানের কর্মচারী সোহানাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মা আছিয়া বেগম বাসে আটকে পড়েন। ফলে আহত জসিম উদ্দিন স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় দুই যুবক আছিয়া বেগমকে উদ্ধার করে বের করার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয় এবং পুরো গাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্ঘটনায় অন্য আহতদের সঙ্গে তাঁদের সবাইকে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহানার মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় মা আছিয়া বেগমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সোহানার এমন অকালমৃত্যু কেউ যেন মেনে নিতে পারছে না। জেলা হাসপাতালের লাশঘরে তাঁর মৃতদেহ দেখে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। খবর পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা জেলা হাসপাতালে ছুটে যায়। বুধবার রাতে তারা সোহানার মৃতদেহ গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামে নিয়ে যায়।
এদিকে সোহানার মৃত্যুর সংবাদে কলেজের সহপাঠীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তারা সবাই সোহানার গ্রামের বাড়িতে ছুটে এসেছে এবং প্রিয় বন্ধুর মৃতদেহ দেখে পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি নিজেদের চোখের পানি ফেলেছে। দুপুরে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মৃতদেহ দাফন করা হয়।
পরিবারের লোকজন জানায়, সোহানা খুব বন্ধুবৎসল ছিল। সম্প্রতি পরিবারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা চলছিল। সহপাঠীরা জানায়, গত ৩ আগস্ট সোহানা ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এরই মধ্যে তিনি দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তারা হতবিহ্বল। ঘটনার পর থেকে তাঁর ফেসবুকের ওয়ালে অনেক বন্ধু ও সহপাঠী তাঁর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে।
গতকাল বিকেলে মোবাইল ফোনে কথা হয় নিহত সোহানার বাবা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোহানা আমার কলিজার টুকরো ছিল। আমি অসুস্থ, সে আমায় সব সময় আগলে রাখত। সে আমাকে বলত, বাবা, তোমার কিছু হয়নি, মিছে ভয় পাও। কিন্তু সে-ই আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। তার মায়ের অবস্থাও ভালো নয়। দুর্ঘটনার পর তার জ্ঞান ফেরেনি। সোহানা যে নেই, কী করে বলব তাঁকে?
তদন্ত কমিটি গঠন : নরসিংদীর শিবপুরে যাত্রীবাহী দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জিন্নাত রেহেনাকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। সরু মহাসড়ক ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। নিহতরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উলুঘাট এলাকার পচন আলী মোল্লার ছেলে মো. বাছির মিয়া (৪০), একই জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রামের জসিম উদ্দিনের মেয়ে সোহানা আহমেদ (১৮), নরসিংদী সদর উপজেলার রাইনাদী এলাকার সফর আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩০), দীঘিরপাড় এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে নূরে আলম (৩০), রায়পুরা চরমরজাল এলাকার চান মিয়ার স্ত্রী নূরজাহান (৫০), একই উপজেলার চরহলদী গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে মজনু মিয়া (৬০), শিবপুরের রমিজ উদ্দিন (৭০), আব্দুল হান্নান মিয়া (৫০) এবং বেলাবো উপজেলার রিজিয়া (৪৫)। তদন্ত কমিটি গতকাল বৃহস্পতিবার তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বলে জানা গেছে।