মাওয়ায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গতকাল মাওয়ার পদ্মা রেস্ট হাউসে গণশুনানি করেছে। এদিকে দুপুরে মাওয়া ঘাট এলাকায় পিনাক-৬ শনাক্ত হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ খবরে পদ্মাপাড়ে মাওয়া ঘাটে মানুষের ঢল নামে। তবে এখনো লঞ্চ শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি।
জানা গেছে, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গণশুনানি শুরু হয়। এ সময় দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চে থাকা যাত্রী চামেলি বেগম, আবুল কালাম, বিউটি আক্তার, ইদ্রিস ঢালী ও আনিসুর রহমান এবং প্রত্যক্ষদর্শী দুই উদ্ধারকারী সি-বোট চালক মনির হোসেন ও মাহবুব হোসেন সাক্ষ্য প্রদান করেন। গণশুনানিতে আবুল কালাম (৭০) তার বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরে লঞ্চডুবির ভয়াল সেই কাহিনী বর্ণনা করেন। বেলা ১১টা থেকে শুরু করে সোয়া ২ ঘণ্টা গণশুনানি চলে।
গণশুনানি শেষে তদন্ত কমিটির প্রধান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব নূর-উর-রহমান জানান, তারা লঞ্চডুবির স্থান, পদ্মার ওপারে কাওড়াকান্দি ও কাঁঠালবাড়ী ঘাট পরিদর্শন এবং সেসব স্থানে নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজন, বেঁচে আসা যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। তিনি জানান, ‘আমরা মূলত গণশুনানিতে বেঁচে যাওয়া যাত্রী, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় উদ্ধারকর্মীদের সাক্ষ্য নিতে এসেছি।’ ১০ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবেন বলে তিনি জানান। এ সময় তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব, সমুদ্রবন্দর অধিদফতরের ক্যাপ্টেন এ কে এম জসিম উদ্দিন, সদস্য- বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকৌশলী মো. ফিরোজ আহম্মেদ, বিআইডব্লিউটিসির প্রকৌশলী আবদুর রহিম তালুকদারসহ বুয়েট প্রতিনিধি অধ্যাপক গৌতমকুমার সাহা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।এদিকে, গতকাল বিকাল ৩টার দিকে মাওয়া ঘাটে খবর ছড়িয়ে পড়ে পিনাক-৬ শনাক্ত করা হয়েছে। কপ্পা বাহিনী এ কাজটি করেছে বলে চাউর হয়ে যায়। সবার মুখে একটিই কথা- এই কপ্পা বা টোটকা বাহিনীকে লঞ্চটি শনাক্ত করতে দিলে আরও আগেই শনাক্তসহ উদ্ধার করা সম্ভব হতো। এখন তো সেই স্থানীয় ডুবুরিরাই পিনাককে শনাক্ত করেছেন। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কপ্পা বাহিনীর এক ডুবুরি জানান, তারা যে স্থানে লঞ্চটি ডুবে যায় ঠিক সেখানেই পিনাক-৬ শনাক্ত করে ড্রাম দিয়ে স্থান চিহ্নিত করে রাখেন এবং কাছি (রশি) দিয়ে তাকে আটক করেন। কিন্তু নদীতে অতিরিক্ত স্রোত থাকায় তারা কাজ সম্পন্ন করার আগেই নৌপুলিশের তাড়ায় তা ভেস্তে যায়। কী কারণে তাদের পিনাক শনাক্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না তা তাদের জানা নেই। তারা সনাতন পদ্ধতিতে লঞ্চটি শনাক্তের চেষ্টা করতে থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সোমবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তারা প্রশাসনের ভয়ে মুখ খুলছেন না বলে উল্লেখ করেন। তাই তারাও এখন বলছেন, পদ্মায় প্রচণ্ড স্রোত তাই আর পিনাককে খুঁজে বের করা সম্ভব নয় বলে সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছেন সনাতন পদ্ধতিতে লঞ্চ শনাক্তকরণ অভিযান। ওই দিনই লঞ্চডুবির স্থানে বড় আকারের একটা কিছু তাদের জালে আটকায়। এ সময় তাদের দলনেতা হাসান দাবি করেন এটাই পিনাক-৬। সে সময় তারা শতকারা ৯৫ ভাগ নিশ্চয়তাও দেন এটাই পিনাক-৬। মাওয়া ফেরিঘাটের চেইন ব্যবসায়ী হাসান পাঠান দুটি ট্রলারে ১৫ জন নিয়ে এ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন। স্থানীয় লোকজন দাবি করেন, লঞ্চটি উদ্ধারের অনুমতি দিলে তারা অনায়াসে তা শনাক্ত করে দিতে পারবেন। তাই সরকারের কাছে তাদের দাবি, কপ্পা বা টোটকা বাহিনীকে সে সুযোগ দেওয়া হোক।
বৃদ্ধ কালাম ভুলতে পারছেন না ভয়াল স্মৃতি : বয়সের ভারে ন্যুব্জ হওয়া আবুল কালাম শেষ বয়সে এসে মারাত্মক নৌ-দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ায় নতুন জীবন পেয়েছেন বলে মনে করেন। কিন্তু এক মুহূর্তও ভুলতে পারেন না সেই ভয়াল মুহূর্তগুলো। বৃদ্ধ কালাম ডুবে যাওয়া পিনাকের নিচ তলার যাত্রী ছিলেন। কাওড়াকান্দি লঞ্চঘাট থেকে পিনাক-৬-এর যাত্রী হিসেবে সেদিন নিচ তলায় ঠাঁই হয় তার। ওই সময় প্রায় ২০০ যাত্রী ওঠানো হয় লঞ্চটিতে। পাঁচটি যাত্রীবাহী বাসের সব যাত্রীকে ওই লঞ্চে ওঠানো হয়েছিল। এরপর আবার কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে যাত্রী ওঠানো হয়। চলতে ছিল ভালোই কিন্তু শেষ দিকে লঞ্চটি আর পেরে ওঠেনি। তিনি বলেন, ‘প্রায় ঘাটের কাছে চলে এসেছিলাম আমরা। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি ও নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ শুরু হয়। মাঝেমধ্যে ঢেউয়ের পানি লঞ্চের ভিতর ঢুকতে শুরু করে। আমি প্রাণভয়ে প্রথমে লঞ্চের দোতলায় উঠি। এরপর ছাদে উঠে যাই। ছাদে ওঠার মিনিটখানেক পরই ঢেউ আরও বড় আকার ধারণ করে। এ সময় মানুষ শুধুই আহাজারি করতে থাকে। আল্লাহ, ভগবান, কোরআন, গীতা যে যাই জানে তা পড়তে থাকে আর চিল্লাচিল্লি করতে থাকে। চোখে যেন শর্ষেফুল দেখতে থাকি। বুঝিনি বেঁচে যাব। আমিও দোয়া পড়তে থাকি। সাঁতার জানা ছিল তাই বুড়ো হলেও তা ভুলিনি। ছাদে ওঠার আগে দেখেছি মা, বোন আর শিশুদের সে কী আহাজারি। ছাদে ওঠার পর প্রথম ঢেউয়ে দেখলাম লঞ্চটি কাত হয়ে গেল এবং পরের ঢেউয়ে একেবারেই শেষ। আমি বাঁচার জন্য পানিতে আস্তে করে ভেসে থাকার চেষ্টা করি। আমাকে কারা যেন টেনে সি-বোটে উঠাল। এর পরও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি বেঁচে আছি।’ বৃদ্ধ আবুল কালামের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সামসকান্দি গ্রামে।
উল্লেখ্য, ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে কাওড়াকান্দি থেকে আড়াই শ যাত্রী নিয়ে মাওয়া ঘাটে যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ক্রসিংয়ে পদ্মায় ডুবে যায় লঞ্চটি। গতকাল সকালে শরীয়তপুরে আরও এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে এ ঘটনায় ৪৭ জনের লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ অনেকে। তবে সরকারের হাতে ৬১ জন নিখোঁজের তালিকা রয়েছে।
উদ্ধারকাজে কোনো ফলাফল ছাড়াই আট দিনের মাথায় ১১ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে লঞ্চ উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল।