দিলখোশ বিক্রির সামান্য আয়ে চলে ছয়জনের সংসার। এর ওপর রয়েছে পড়াশোনা, জামাকাপড়সহ অন্যান্য খরচ। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা। সব মিলিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্বপ্না আক্তার স্বপ্ন লালন করেছে তার অন্ধ দুটি চোখে। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে সে এবার পেয়েছে জিপিএ-৫। কোন প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি তাকে।
জন্ম থেকেই অন্ধ স্বপ্না আক্তার রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন তার একটাই স্বপ্ন- ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে বড় সরকারি কর্মকর্তা হবে।
স্বপ্নার বাড়ি রাজবাড়ী শহরের বিনোদপুর এলাকার রেলওয়ে কলোনির বস্তিতে। জন্ম থেকেই সে অন্ধ। তারা তিন বোন ও এক ভাই। ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় সে। স্বপ্নার দরিদ্র পরিবারের বাবা আবুব্বর মোল্লা দিলখোশ ভাজা বিক্রেতা। মা রোকেয়া বেগম গৃহিণী। মেজো বোন রত্না আক্তার ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে। ভাই লুৎফর রহমান মোল্লা ও ছোট বোন মরিয়ম আক্তার স্কুলে পড়ে। পরিবারে চরম দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী।
স্বপ্না জানায়, ছোটবেলায় তার দেখা হয় রাজবাড়ী জেলা শহরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলের প্রধান শিক্ষক বোরহান উদ্দিন হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি তাকে মেয়ের মতো কাছে টেনে নেন। তার সহযোগিতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে স্বপ্না ভর্তি হয় জেলা শহরের ইয়াছিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে সে ‘এ’ গ্রেডে এসএসসি পাস করে। এরপর মানবিক বিভাগে ভর্তি হয় রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজে। এ কলেজ থেকেই এবার এইচএচসি ২০১৪ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পায় সে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই মেধাবী বলে, ‘আমাকে ব্রেইল পদ্ধতির বই পড়তে হয়। এসব বই সংগ্রহ করা ব্যয়বহুল ব্যাপার। এইচএসসির বই সংগ্রহ করতে আমার খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। আগামীতে অনার্সে ভর্তি হলে উপায় কি হবে, তা ভেবে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। তবে আল্লাহ সহায় হলে এ বাধা আমি ডিঙিয়ে যাবো। লেখাপড়া শেষ করে আমি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। আমার একটাই স্বপ্ন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করে বড় সরকারি কর্মকর্তা হওয়া। তাহলেই সম্ভব হবে বস্তি থেকে পরিবার তুলে এনে নির্দিষ্ট কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয়া।’শিক্ষক বোরহান উদ্দিন হাওলাদারের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘স্বপ্না আমার পরিবারের একজন। আমার স্বামী ওকে নিজের মেয়ের মতো কাছে টেনে নিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে আসছেন। ওর অর্থের অভাব দূর করতে নানা চেষ্টাও করেছেন। যে কারণে সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সমাজের নানা মানুষের সহযোগিতা পেয়ে স্বপ্না আজ অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে।’
সহপাঠী রিমা রানী হালদার বলেন, ‘স্বপ্না নিয়মিত ক্লাস করত। ক্লাসের সবাই ওকে ভালবাসত। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় শিক্ষকরাও ওর প্রতি আলাদা দৃষ্টি দিতেন।’
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান খান বলেন, ‘স্বপ্না এ কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার পর আমরা দেখতে পাই যে মেয়েটির লেখাপড়ায় ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। যে কারণে শুরু থেকেই শিক্ষকরা ওর পাশে দাঁড়ান। ওর যাতায়াতের ব্যয় বহন করার পাশাপাশি উপবৃত্তি প্রদান এবং বই কেনার জন্যও সহযোগিতা করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ওর। আমরাও চাই সে ইচ্ছা সফল হোক। তবে ওর জন্য এ কলেজের দরজা সব সময় খোলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে সে এখানে পড়ার সুযোগ পাবে।’
এদিকে, এইচএসসির ফল প্রকাশের পর স্বপ্নাকে কাছে ডেকে নেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম খান। তিনি তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন, চিন্তা করো না তোমার পাশে আছি, থাকবো। স্বপ্নার এ সাফল্যে তার পরিবার, সহপাঠীরা আনন্দিত।