ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না কেন? এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর: মধ্যপ্রাচ্যে সবাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, কিন্তু শান্তির পক্ষে নয়।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাব অনুসারে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। সাড়ে ছয় দশক পরে ইসরায়েল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। আর ফিলিস্তিনবাসীর জন্য স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র (একটি ইহুদি, অন্যটি আরব) গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। অসম ও অন্যায্য
এই যুক্তিতে আরবেরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। উল্টো ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে আরবেরা পরাজিত হয় এবং ইসরায়েল জাতিসংঘ পরিকল্পনায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশের জায়গায় মোট ৭৭ শতাংশ দখল করে নেয়। এরপর যে এক চিলতে জমি পড়ে রইল, সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা যেত। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে মিসর ও জর্ডান তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম গেল জর্ডানের বাদশাহর কবলে, গাজার দখল নিল মিসর।
এরপর গত ৬০ বছরে আরব সাগর দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, তার চেয়েও বেশি গেছে ফিলিস্তিনিদের কান্না ও লহু। আমরা সেই কাহিনিতে যাব না। চলে আসা যাক চলতি সময়ে। ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় নামকাওয়াস্তে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। তত দিনে অবশ্য সেই অঞ্চলের একটা বড় অংশ ইসরায়েলের অবৈধ বসতির কবলে, অথবা সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। নামেই স্বায়ত্তশাসন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চৌপ্রহর ইসরায়েলি প্রহরা, উঁচু দেয়াল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে ইসরায়েলি অনুমতি, ফলে এমন দেশকে স্বাধীন না বলে বান্টুস্থান বলাই অধিক সংগত। কিন্তু সেই প্রশাসনও দুই টুকরা হয়ে গেল ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। পশ্চিম তীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, গাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের। দুজনের সঙ্গে কথা বন্ধ, যখন-তখন বন্দুকযুদ্ধ। হামাস সন্ত্রাসবাদী দল ও ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, এই অভিযোগে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দলটির সঙ্গে সব সম্পর্ক বর্জন করে। যত দিন না হামাস-ফাতাহ কাজিয়া মিটছে, ফিলিস্তিন প্রশ্নে শান্তি চুক্তি অসম্ভব। ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা থাকায় হামাসের ওপর আক্রমণ করেও ইসরায়েল পার পেয়ে যায়, এমনকি নিজেকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করতে পারে। ফলে এই কাজিয়া চলতে থাকাই ইসরায়েলের জন্য লাভজনক। অন্যদিকে নিজেরা যে আলাপ-আলোচনা করে কাজিয়া মেটাবে, ফাতাহ বা হামাস—কেউই তাতে আগ্রহী নয়। কারণ, ঝগড়া মেটামাত্রই নির্বাচন হবে, আর সেই নির্বাচনে দুই দলের চলতি নেতৃত্বের প্রত্যেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় নেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
হামাস ও ফাতাহর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে নয়, ইসরায়েলের প্রতি সম্পর্কের প্রশ্নেও। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকার আপসের পথ বেছে নিয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করে, তাদের মূল লক্ষ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয়, ফাতাহর চলতি নেতৃত্বকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে, হামাস সব ধরনের আপসের বিরোধী। সেটাই তাদের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার। কোনো কোনো মিসরীয় ও মার্কিন ভাষ্যকারের ধারণা, এবারের যুদ্ধ হামাসের উসকানিতে। ইসরায়েল ও মিসর এই দুই দিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে এবং সিরিয়া ও ইরানের সমর্থন খোয়ানোয় তারা বেপরোয়া হয়ে পড়ছিল। তাদের টাঁকশাল কার্যত শূন্য, সরকারি কর্মচারীদের বেতনের অর্থ পর্যন্ত নেই। এসব ভাষ্যকারের দাবি, একটা যুদ্ধ বাধলে গাজাবাসীর কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিকভাবে নিজের অবস্থা দৃঢ়তর করা সম্ভব হবে, সেই যুক্তিতে এই যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা। তাদের কথা ঠিক হোক বা না হোক, মানতেই হবে গাজার সর্বশেষ যুদ্ধ হামাসকে নতুন জীবন দান করেছে। ফাতাহ ও হামাসের ওপর চাপ রয়েছে তাদের বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের। এ বছরের এপ্রিলে তেমন একটা চুক্তিও হয়েছে, যদিও তা কার্যকর হয়নি। এখন, ক্রমবর্ধমান চাপ ও বাস্তবতার কারণে সেই সরকার যদি গঠিত হয়, হামাসের আশা সেখানে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
আরব রাজা-বাদশারা চাইলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসরায়েলের ওপর চাপ দিতে পারত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার করতে পারত। কিন্তু এবারের হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে আবারও পরিষ্কার হয়ে গেছে, প্রতিবেশী কোনো আরব দেশই এ ব্যাপারে কুটোটিও নেড়ে দেখবে না। অন্ততপক্ষে যত দিন হামাসকে তাড়ানো না যায়। মিসরের সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সৌদি আরবের বাদশাহজাদারা ইসলামিক ব্রাদারহুডকে তাঁদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক মনে করেন। প্রেসিডেন্ট মোবারকের পতনের