আটকের পর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ১৭৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে র্যাব। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে র্যাব বিষয়টি তদন্ত করলেও তদন্তকাজে পুলিশ সহায়তা করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বারবার নোটিশ দিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের তদন্ত দলের সামনে হাজির করা যাচ্ছে না। এছাড়া পুলিশ যাদের আটক করেছিল তাদেরকেও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে অভিযোগকারীরা এখন র্যাবের তদন্ত দলের কাছে পুলিশের আটক বাণিজ্য নিয়ে কোন কথা বলতে চাইছে না। অপরদিকে পুলিশ ও আটককারীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীরাও হয়ে গেছে লাপাত্তা। তালিকাভুক্ত মধ্যস্থতাকারীর অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকেই মধ্যস্থতা করার কথা অস্বীকার করছে। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ সদস্যরা ব্যাপক গ্রেপ্তার বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নামে বিরোধী নেতাকর্মীকে ও মাদকসহ কাউকে কাউকে আটকের পর উৎকোচের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ ঘুষ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। গত মার্চে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা দুই দফায় ১৭৫ জন পুলিশ সদস্যের এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রধানমন্ত্রী এসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শককে বলা হয় ব্যবস্থা নিতে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, তদন্ত চলছে। তদন্তের বিষয়টি এখনও শেষ হয়নি। র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নকে এ সব তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু রিপোর্ট এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে নতুন করে তদন্ত প্রক্রিয়া ঠিক করা হবে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের আওতাধীন এলাকার অভিযোগগুলো সে সব ব্যাটালিয়নের কাছে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়ন থেকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের তদন্ত দলের সামনে হাজির করার জন্য একাধিকবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। তবে কোন কোন এলাকার পুলিশ সদস্যরা তদন্ত দলের সামনে হাজির হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অভিযুক্তরা তদন্ত দলের সামনে হাজির হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরী এলাকার সূত্রাপুর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এলাকার ১০ পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র্যাবের ১০ নম্বর ব্যাটালিয়নকে। সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গত মে মাসে সংশ্লিষ্ট এলাকা লালবাগের উপকমিশনার বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই চিঠির কোন সাড়া দেয়া হয়নি। পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার হারুন-অর-রশিদ এ সংক্রান্তে কোন চিঠি পাওয়ার কথাই অস্বীকার করেন। সূত্র জানায়, নিউ মার্কেট, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও থানার কয়েক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব-২ কার্যালয় থেকে উপকমিশনার তেজগাঁও ও রমনা বরাবর চিঠি ইস্যু করা হয়। কিন্তু সেই চিঠির কোন উত্তর মেলেনি। র্যাবের তদন্ত দলের কাছে হাজির হননি কেউ। পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার ওয়াহিদুল আলম বলেন, উপকমিশনার তেজগাঁও বরাবর র্যাব-২ থেকে একটি চিঠি দিয়েছিল। আমরা সেই চিঠির একটি উত্তর দিয়েছি। চিঠিতে তাদের যথা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আসার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কোন পুলিশ সদস্যকে ডাকতে হলে হয় ডিএমপি কমিশনার অথবা আইজিপি মহোদয় বরাবর চিঠি দিতে হবে। সেখান থেকে অনুমতি এলেই আমরা অভিযুক্তদের র্যাবের তদন্ত দলের সামনে পাঠাবো। সূত্র জানায়, একই ভাবে পল্লবীর এসআই হেলাল, কাফরুল থানার এসআই মনির, এসআই হেলাল ও উত্তরা পূর্ব থানার ওসি সাহাদত হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিরপুর ও উত্তরার উপকমিশনার কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হলে তারাও চিঠির কোন উত্তর দেননি। তবে মিরপুরের ডিসি ইমতিয়াজ জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। এ ধরনের কোন চিঠিও তিনি হাতে পাননি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় যে ৩০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিলের নেতৃত্বে এই কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্য ডিএএমপি’র ডিসি (ডিসিপ্লিন) আবুল কালাম সিদ্দিকি জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে কিনা তা বলা যাবে না। সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের অভিযুক্ত সদস্যরা তাদের চিঠিতে সাড়া না দিলেও ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় র্যাব কিছু পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সিলেটের র্যাব-৯ (সিলেট)-এর সিও উইং কমান্ডার রিয়াদ হাসান রাব্বানী জানান, তারা অভিযুক্ত ৬ পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে তদন্ত করেছেন। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন র্যাব সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
মধ্যস্থতাকারীরা লাপাত্তা, অভিযোগকারীরা সংশয়ে: সূত্র জানায়, পুলিশের আটক বাণিজ্যের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের বেশির ভাগই লাপাত্তা হয়ে গেছে। তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি অনেকেই র্যাবের তদন্তে সহযোগিতা করছে না। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের এই আটক বাণিজ্যের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেয়া এ সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় আটক বাণিজ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার নাম রয়েছে। নিউ মার্কেট এলাকায় মধ্যস্থতা করেছেন আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড নীলক্ষেত ইউনিট ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের কতিপয় নেতা। আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মোখলেছুর রহমান। রাজধানীর বাইরেও বেশির ভাগ এলাকার মধ্যস্থতাকারী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মধ্যস্থতাকারীদের বিষয়েও তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, থানা পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া অনেক অভিযোগকারী এখন আর ভয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। নতুন করে আবারও হয়রানি হতে পারে এই সংশয়ে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন।