উপমহাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম আর নেই। দীর্ঘ রোগভোগের পর গতকাল রাত ৮টা ২৮ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি তিন পুত্র তাহসিন, সংগীত তারকা হামিন আহমেদ, শাফিন আহমেদ, পুত্রবধূ কণ্ঠশিল্পী কানিজ সুবর্ণাসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। গেল কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন ফিরোজা বেগম। গত শুক্রবার থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর সোমবার সকাল থেকে তার অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে থাকে। হৃদযন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছিল না। সঙ্গে ছিল জন্ডিস এবং কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে যাওয়া। ফিরোজা বেগমের ছেলে হামিন আহমেদ মানবজমিনকে জানান, আগে থেকেই মায়ের কিডনি’র সমস্যা ছিল। এতদিন ডায়লাইসিস করে ভালই ছিলেন। সঙ্গে জন্ডিস দেখা দিয়েছে। তবে সোমবার সকাল থেকে হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। ওই সময় লিভারও বিকল হয়ে যায়। এদিকে ফিরোজা বেগমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুর খবরে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভিড় করেন শুভানুধ্যায়ীরা।
রাতে ফিরোজা বেগমের লাশ এ্যাপোলো হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। সকালে লাশ নেয়া হবে ইন্দিরা রোডের বাসায়। বেলা দুইটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লাশ রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে কিংবদন্তি এ শিল্পীকে।
১৯৩০ সালের ২৮শে জুলাই ফরিদপুরের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফিরোজা বেগম। তার পিতা খান বাহাদুর সাহেব মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলমান কৌঁসুলি। তার মা বেগম কাওকাবুন্নেসা। তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয় ফিরোজা বেগম। ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগীত সাধনা করেছেন ফিরোজা বেগম। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। নজরুলের গান নিয়ে সারা বিশ্বে ঘুরেছেন ফিরোজা বেগম। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গান প্রচারে অবদান রয়েছে তার। নজরুলসংগীতের প্রথম ‘লংপ্লে’তে তার কণ্ঠে দু’টি গান রয়েছে। তালাত মাহমুদের প্রথম ঢাকা সফরের সঙ্গী ছিলেন ফিরোজা বেগম। রেডিওতে বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের সঙ্গে ঠুমরি গাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে তার ঝুলিতে। দেশবিভাগের পর পরিবারসহ ১৯৬৭ সালে ঢাকায় এসে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েন শিল্পী ফিরোজা বেগম। পকিস্তান সরকার তাকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেয়। নজরুল সংগীতশিল্পী হলেও ফিরোজা বেগম রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক গান, ইসলামিক গান, লোকগানও গেয়েছেন। গ্রামোফোন রেকর্ড তো বের হয়েছেই, রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে তার অসংখ্য গান। তবে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে কখনও আগ্রহবোধ করেননি। গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান রেকর্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে তার পরিচয় হয় সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে। ১৯৫৬ সালে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। কলকাতাতেই জন্মেছে তার তিন সন্তান তাহসিন, হামিন ও শাফিন। ১৯৭৪ সালে মারা যান স্বামী কমল দাশগুপ্ত। বিভিন্ন সময়ে নানা সম্মাননা পেয়েছেন ফিরোজা বেগম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার প্রভৃতি।