বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সাম্প্রতিক কালে বছরে গড়ে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু বাণিজ্য সহজীকরণ (ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন) প্রক্রিয়া না থাকায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে দুই দেশেরই ব্যয় বাড়ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাণিজ্য সম্প্রসারণ।
বাণিজ্য সহজীকরণ বলতে ব্যবসাসংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও প্রক্রিয়াগুলোকে জটিলতামুক্ত করে ব্যবসা পরিচালনার কাজ সহজে সম্পন্ন করার পদক্ষেপকে বোঝায়। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সহজীকরণ হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের খরচ থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হতে পারে। আর এটি হলো বিদ্যমান বাণিজ্য খরচের ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
ভারতের জয়পুরভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কনজিউমার ইউনিটি ট্রাস্ট সোসাইটি (কাটস) ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ হিসাব তুলে ধরেছে। ‘অ্যাসেসমেন্ট অব বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ট্রেড পোটেনশিয়ালিটি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে ২০১১ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়েছে।
তবে ২০১১ সাল থেকে ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পাওয়ার পরও ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি অব্যাহতভাবে বাড়েনি। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্য আগের মতোই বড়ভাবে ভারতের অনুকূলে রয়ে গেছে।
গবেষণা সম্পন্ন করতে দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত বিভিন্ন শুল্কস্টেশন পরিদর্শন করেছেন কাটসের গবেষকেরা। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই দেশের সীমান্তে পর্যাপ্ত অবকাঠামোর ঘাটতি আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাধা তৈরি করছে। স্থল শুল্কস্টেশনসংলগ্ন এলাকায় পর্যাপ্ত গুদাম, পার্কিংব্যবস্থা ও হিমাগার নেই। আমদানি-রপ্তানির কাগজপত্র প্রক্রিয়া করতে অনেক সময় লেগে যায়। যথেষ্ট ব্যাংকিংসুবিধা নেই। পণ্যবাহী ট্রাকের জন্য জ্বালানি পেতে অনেক দূরে যেতে হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১৮১টি অনুমোদিত শুল্কস্টেশনের মধ্যে চার বছর ধরে ১৪২টি বন্ধ রয়েছে। মূলত পণ্য আমদানি-রপ্তানির ন্যূনতম অবকাঠামো না থাকায় এসব শুল্কস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
দেশের মাত্র ৩৯টি স্থলবন্দর কার্যকর রয়েছে। এগুলো দিয়ে নিয়মিত না হলেও বছরে ন্যূনতম একটি পণ্যের চালান খালাস হয়। আর দেশের ১০-১২টি শুল্কস্টেশন তথা স্থলবন্দর ছাড়া আর কোনোটি দিয়ে নিয়মিত পণ্য আসা-যাওয়া করে না। টেকনাফ স্থলবন্দর ছাড়া আর সবগুলোই ভারতের সঙ্গে। প্রতিটি শুল্কস্টেশন দিয়ে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি আমদানির অনুমোদন রয়েছে। একেকটি শুল্কস্টেশন দিয়ে একেক রকমের পণ্য আমদানি-রপ্তানির তালিকা আছে।
কাটস বলছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে অবকাঠামো ও বাণিজ্য সহজীকরণের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো দুটি। একটি হলো দ্বিপক্ষীয় পণ্য পরিবহন ও ট্রানজিটব্যবস্থা না থাকা। অপরটি হলো বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট মানের (স্ট্যান্ডার্ড) সঠিক প্রয়োগের অভাব।
বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পাদনে এসব অদক্ষতা দুই দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য তথা চোরাকারবার বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করে কাটস। বর্তমানে যে পরিমাণ আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য হয়, তার অন্তত অর্ধেক পরিমাণ অনানুষ্ঠানিক পথে হয় বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অবশ্য অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের এই প্রাক্কলন অত্যন্ত রক্ষণশীল। কেননা, অন্যান্য একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পরিমাণ আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের তুলনায় দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৬৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর বাংলাদেশ ভারতে ৪৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ কম। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল ৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
এর বিপরীতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। গত অর্থবছর তা ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬১০ কোটি ডলার।
অবশ্য কাটস অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পরিমাণকে যুক্ত করেছে অশুল্ক বাধার সঙ্গে। বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যে অশুল্ক বাধা বিদ্যমান থাকার প্রতিফলনই হলো অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য। আর তাই বাণিজ্য সহজীকরণের মাধ্যমে বৈধ পথে বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে কাটসের উপনির্বাহী পরিচালক বিপুল চ্যাটার্জি প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য অঞ্চলের বাইরে থেকে আমদানি করে বছরে গড়ে ২০০ কোটি ডলার বেশি খরচ করছে। অথচ এসব পণ্য এই অঞ্চলের এক দেশ অন্য দেশ থেকেই আমদানি করতে পারে। তাতে ব্যয়ও সাশ্রয় হয়।
বিপুল আরও বলেন, বাংলাদেশি ভোক্তারা বছরে ৪০ কোটি ডলারের মতো সাশ্রয় করতে পারেন এই আঞ্চলিক সুবিধা নিয়ে। এর মধ্যে ৩৬ শতাংশই হতে পারে যদি ভারত থেকে জ্বালানি তেল, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য, ওষুধসামগ্রী ইত্যাদি আমদানি করা হয়। অন্যদিকে ভারতীয় ভোক্তারা এই অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি করে বছরে ৬০ কোটি ডলার সাশ্রয় করতে পারেন। অবশ্য এর ২ শতাংশ আসতে পারে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও আনুষঙ্গিক পণ্য আমদানি করে।