১৩ সেপ্টেম্বর ভোরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নেমেই দেখি, রাস্তায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, অপরিচ্ছন্ন ফুটপাত। প্রাচ্যের রানী নামে খ্যাত সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত এই বন্দরনগরটি একেবারেই শ্রীহীন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বছর চারেক আগে যখন চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, অনেকটা পরিষ্কার ও ছিমছাম ছিল। অন্তত ঢাকার তুলনায় সব দিকে এগিয়ে ছিল। এবারে ঠিক উল্টো। কোনো কোনো সড়ক প্রশস্ত করা হলেও কাজ অসমাপ্ত। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হলো অপরিকল্পিত সাইনবোর্ড ও ব্যানার। বেশির ভাগই সরকারি দলের নেতাদের ব্যক্তিগত প্রচার ও দলীয় প্রধানের স্তুতিতে ভরা। নগরের একটি মোড়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের নামাঙ্কিত একটি হোর্ডিং দেখলাম। তাতে লেখা, ‘শেখ হাসিনার উন্নয়ন, বদলে গেছে চট্টগ্রাম।’
হ্যাঁ, চট্টগ্রাম বদলে গেছে। তবে ভালোর দিকে নয়, খারাপের দিকে।
সাতসকালে চট্টগ্রাম শহর জাগে না। দু-চারটি রিকশা ও বেবিট্যাক্সি ইতস্তত চলাচল করছিল। দোকানপাট তখনো খোলেনি। রেলস্টেশন থেকে জুবিলী রোডে আল ফায়সাল হোটেলে গিয়েই টের পেলাম চট্টগ্রামের জনজীবন কতটা বিপর্যস্ত। হোটেলকর্মীরা জানালেন, গত রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। কয়েক ঘণ্টা ধরে জেনারেটর দিয়ে সীমিত পাখা ও বাতি চলছিল। এখন তাও বন্ধ। কিছুক্ষণ পর চালু হবে।
এরপর জুবিলী রোড থেকে হিলভিউ আবাসিক এলাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে গিয়ে দেখি, সেখানেও বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর দিয়ে কাজকর্ম চলছে। সহকর্মীরা জানালেন, কয়েক দিন ধরেই এ অবস্থা। ঢাকায় যেখানে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হয় না, সেখানে চট্টগ্রামে সাত-আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং চলে। এমনকি বিকেলে প্রথম আলো আয়োজিত ‘জোয়ারের পানিতে বিপর্যস্ত জনজীবন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক চলাকালেও কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যায়। গত জুলাই থেকে এ অবস্থা চলছে চট্টগ্রামের প্রতিটি আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকায়। এই হলো দেশের প্রধান বন্দর ও শিল্পনগরের হাল।
গোলটেবিল বৈঠকেই আগ্রাবাদ এলাকার একজন বাসিন্দা জানালেন, চতুর্মুখী সমস্যায় তাঁদের জীবন বিপন্নপ্রায়। প্রথমত, জোয়ারের পানিতে তাঁদের ঘরবাড়ি ডুবে যায়, রাস্তায় রিকশা ছাড়া কোনো যানবাহন চলে না। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। এক জোয়ারের পানি চলে যেতে না-যেতেই ফের জোয়ার আসে। দ্বিতীয়ত, লোডশেডিংয়ের কারণে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়। বিদ্যুৎ না থাকায় পানির পাম্পগুলোও অকেজো। তৃতীয়ত, মেরামতের অভাবে রাস্তাঘাটগুলো যান চলাচলের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে। শহরের ড্রেনেজব্যবস্থা খুবই নাজুক। চতুর্থত, যানজটেও নগরবাসীকে প্রায়ই নাকাল হতে হয়।
সরকার চট্টগ্রামের বাহারি নাম দিয়েছে—বাণিজ্যিক রাজধানী। একজন ব্যবসায়ী সখেদে বললেন, ‘ভাই, বাণিজ্যিক রাজধানী করতে কী কী লাগে জানেন?’ তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললেন, যানজট, জলাবদ্ধতা, বিদ্যুৎবিভ্রাট ও অপরিকল্পিত উন্নয়েনর অপর নাম বাণিজ্যিক রাজধানী।
এসবের কারণ কী? চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়নকাজে আগের সেই গতি নেই। যেটুকু হচ্ছে, তাতে রয়েছে প্রচুর সমন্বয়হীনতা। সিটি করপোরেশন কী করছে, সেটি সিডিএ জানে না। আর সিডিএ কী করছে, তার খোঁজ বন্দর কর্তৃপক্ষ রাখে না। সমন্বয় নেই পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাজেও। চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা সমস্যাটি অনেক পুরোনো হলেও কোনো সরকারই সমাধানে এগিয়ে আসেনি।
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে সিটি করপোরেশনের মেয়র মন্জুর আলম ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম—দুজনই নগরবাসীর সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেয়র বিরোধী দলের। তাই নগরবাসীর ধারণা, নগরের উন্নয়নে সরকার সিটি করপোরেশনকে যথেষ্ট অর্থ দেয় না। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়র বহুবার তাগাদা দিলেও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে গত জুনের মহাবিপর্যয়ের পর। সে সময়ে কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
তাঁরা আরও জানান, সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী কিছুটা একগুঁয়েমি চরিত্রের হলেও বেশ করিতকর্মা ছিলেন। সরকার টাকা না দিলেও সিটি করপোরেশনের আয় বাড়িয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। অনেক জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন; যদিও সেসব কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর বর্তমান মেয়র? কেউ বলেন, খুবই সজ্জন ব্যক্তি। বিএনপির লোক হলেও সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলেন। কেউ বলেন, কোনো কাজের নন। কোনোরকমে মেয়াদ পার করতে চান।