চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় বিস্ফোরণের ঘটনার পর এক বছর পেরোলেও গ্রেপ্তার হননি মামলার প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী।হেফাজতে ইসলামের এই নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন কি না সে বিষয়েও কিছু জানে না পুলিশ।তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ঘটনার পর দু-একবার অভিযান ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তারের তৎপরতায় ‘শিথিলতার’ কথা এক কর্মকর্তা স্বীকার করলেও তা মেনে নিতে নারাজ চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার।“মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর মুফতি ইজাহার পরিচালিত জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার (লালখান বাজার মাদ্রাসা) ছাত্রাবাস দারুল ইফতা ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে ওই বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন।এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে হত্যা, বিস্ফোরণ ও এসিড আইনে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। তিন মামলায় মুফতি ইজাহার, তার ছেলে মুফতি হারুণ, মাদ্রাসার তিন শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থীসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।ছাত্রাবাসে বিস্ফোরণের পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ঘটনাকে ল্যাপটপ বিস্ফোরণ বলে চালানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ সেখান থেকে গ্রেনেড সদৃশ বোমা, এসিড ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করে।বিস্ফোরণের দুইদিন পর ১০ অক্টোবর হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনাটিকে পুলিশ ও সংবাদ মাধ্যমের সাজানো ‘নাটক’ বলে দাবি করা হয়।বিস্ফোরণে নিহত তিনজনের মধ্যে হাবিব নামে একজনের পরিবারের খোঁজই পায়নি পুলিশ। কেউ তার লাশের দাবিদার না হওয়ায় আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে তার দাফন হয়।ঘটনার দুদিন পর রাউজান থেকে মুফতি হারুণকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার বাবা ইজাহারকে এক বছরেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।চট্টগ্রামভিত্তিক হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ইজাহার নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। ইজাহারের ছেলে হারুণও হেফাজতে ইসলামের নেতা।জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। পরে জামিনে ছাড়া পান তিনি।বিস্ফোরণের পরদিন ইজাহারকে ধরতে চকবাজার মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে বিফল হয় পুলিশ। এরপর আর কোনো অভিযানের কথা শোনা যায়নি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “ওই বিস্ফোরণের ঘটনার পর দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও নির্বাচনকালীন সময়ে পুলিশের ব্যস্ততার কারণে ইজাহারকে ধরার অভিযানে তেমন গতি ছিল না।”তবে তার ওই বক্তব্য নাকচ করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “মুফতি ইজাহারকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।”ইজাহার দেশের বাইরে চলে গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কঠোর অবস্থানে আছে।“বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারের অভিযান চালানো হলেও ইজাহারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।”গত বছর ওই বিস্ফোরণের সময় মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে নিজের কক্ষে অবস্থান করছিলেন মুফতি ইজাহার। সে সময় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন।একই সময়ে বিস্ফোরণস্থলে পুলিশের বোমা নিস্ক্রীয়কারী দল তল্লাশি চালিয়ে তিনটি হাতে তৈরি গ্রেনেড ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করে।ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মাদ্রাসার ছাত্রাবাস ভবনে বিস্ফোরক মজুদের তথ্য জানার পর ইজারহারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।এরপর সন্ধ্যায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিয়ে মাদ্রাসায় তল্লাশি চালিয়ে ইজাহারের বাসা থেকে ১৮ বোতল এসিড উদ্ধার করা হয়। এ সময় মাদ্রাসা থেকে তিন শিক্ষক তাফসির আহমদ, আব্দুল মান্নান, মো. ইসহাক এবং ডাইনিং সুপার মুনির হোসেন ও শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।সিএমপির বোমা নিস্ত্রীয়করণ ইউনিটের প্রধান সন্তোষ চাকমা বলেন, “জিআই পাইপের ভেতরে মার্বেল, বিস্ফোরক পাউডার দিয়ে বোমাগুলো তৈরি করা হতো। গ্রেনেডের মত স্প্রিং টেনে এগুলো ছোড়া হয়।”এসব বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে আশপাশের অন্তত ৫০০ মিটার পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে জানান তিনি।“মাদ্রাসার ওই কক্ষে বসে বোমা তৈরি করা হতো। বিস্ফোরণের সময় অন্য বোমাগুলো ট্রাংকের ভেতরে থাকায় সেগুলো বিস্ফোরিত হতে পারেনি,” বলেন এসআই সন্তোষ।ইজাহারের অনুপস্থিতিতে বিচারমাদ্রাসায় বিস্ফোরণ এবং নিহতের ঘটনায় হত্যা, বিস্ফোরণ ও এসিড আইনে তিনটি পৃথক মামলা করে পুলিশ, যার প্রতিটিতেই মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি ইজাহারকে প্রধান আসামি করা হয়।এর মধ্যে হত্যা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি চলছে। বিস্ফোরক মামলায় চলছে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং এসিড মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পর্যায়ে রয়েছে।তিনটি মামলাতেই মুফতি ইজাহারের পাশাপাশি তার ছেলে মুফতি হারুণও আসামি। হারুণ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও ইজাহার ঘটনার দিন থেকেই পলাতক।