চাকরির সন্ধানদাতা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিদেশে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে নতুন ধরনের প্রতারণার ফাঁদ পাতছে প্রতারক চক্র। আবেদন করলেই ই- মেইলে মিলছে ‘অফার লেটার’ বা প্রাথমিক নিয়োগপত্র। এরপর স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, প্রতারক চক্র ইন্টারনেটে চাকরির সন্ধানদাতা বিভিন্ন সাইটে (জব সাইটে) বিদেশে চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। অনলাইনে আবেদন করার পর চাকরিপ্রার্থীর মুঠোফোন নম্বরে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে বলা হয়, তাঁকে চাকরির জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এরপর ওই ব্যক্তির ই- মেইলেও পাঠানো হয় ‘অফার লেটার’। তাতে চাকরিস্থল, বেতন ও অন্যান্য সুযোগ- সুবিধার কথা লিখে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতে বলা হয় এ জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে একটি মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে একটি মেডিকেল সেন্টারের ঠিকানা দেওয়া হয়। এরপর সেখানে গেলে টাকা নিয়ে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে খুব দ্রুত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যপরীক্ষা শেষ হওয়ার পর চাকরির নিয়োগদাতা ই-মেইল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং ওই মুঠোফোনও বন্ধ থাকে। পৃথকভাবে এমন প্রতারণার শিকার ১০ জন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যপরীক্ষার কয়েক দিন পর তাঁরা বুঝতে পারেন যে তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। এতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খোয়া যায়। তাই এই ১০ জনের কেউ বাড়তি ঝামেলার আশঙ্কায় পুলিশের কাছে অভিযোগও করতে আগ্রহী হননি। তবে তাঁদের বিশ্বাস, ওই সব মেডিকেল সেন্টারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করা যাবে। প্রতারণার শিকার একজন আবদুল মালেক খন্দকার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরি খুঁজছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি জব সাইটে ডেনমার্কে একটি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করে ই-মেইলে ‘অফার লেটার’ পান তিনি। তাতে বলা হয়, ডেনমার্কের ‘লিডশা রিয়েল এস্টেট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সহকারী মার্চেন্ডাইজ পদে তিনি মনোনীত হয়েছেন। মাসিক বেতন এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। অফার লেটারে একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়। ওই নম্বরে ফোন করার পর স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য দ্রুত বনানীর একটি মেডিকেল সেন্টারে যেতে বলা হয়। ঠিকানা অনুযায়ী তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে যান। একটি বাড়ির দোতলায় কথিত মেডিকেল সেন্টার। যাওয়া মাত্র কয়েকজন দ্রুত তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেন। পরীক্ষা বাবদ তাঁরা চার হাজার ৯০০ টাকা নেন। ওই দিন স্বাস্থ্যপরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তাতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর ওই মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পান। ই-মেইলেও কোনো জবাব নেই। আবদুল মালেকের অফার লেটারে ডেনমার্কের ওই কথিত কোম্পানির বাংলাদেশ এজেন্ট হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তারও কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতারিত অন্যদের ক্ষেত্রেও গল্প একই। কেবল কথিত চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা ও ঢাকায় স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য পাঠানো মেডিকেল সেন্টার ভিন্ন। এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে এ প্রতিবেদকদ্বয়ের একজন ইন্টারনেটে চাকরির সন্ধানদাতা একটি সাইটে ঢুকে সিঙ্গাপুরে বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। যথারীতি আসে খুদে বার্তা ও ই- মেইলে অফার লেটার। বলা হয়, সিঙ্গাপুরের ‘হ্যাজলিল’ নামের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চাকরি তাতে হ্যাজলিলের বাংলাদেশের এজেন্ট হিসেবে চট্টগ্রামের ‘সন্দ্বীপ ওভারসিজের’ নাম রয়েছে। তবে এর বিস্তারিত কোনো ঠিকানা দেওয়া হয়নি। অফার লেটারে থাকা মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে দ্রুত স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য আরামবাগের ইনার সার্কুলার রোডের ‘মেডিনেট মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড’-এ যেতে বলা হয়। মুঠোফোনে এ বিষয়ে কথা বলার একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় দিলে অপরপ্রান্ত থেকে গালি দিয়ে বলা হয়, ‘আপনার ফাইল বাতিল করা হয়েছে।’ এরপর মুঠোফোনটি বন্ধ থাকে। পরে আরামবাগে গিয়ে দেখা যায়, একটি আধা নির্মিত বহুতল ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে মেডিনেট মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেডের সাইনবোর্ড। চলতি বছরের ১৪ জুন এটি উদ্বোধন করা হয়েছে বলে সাইনবোর্ডে উল্লেখ রয়েছে। ভেতরে তিন-চারটি কাচে ঘেরা কক্ষ রয়েছে। মোজাম্মেল হক নামের একজন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘আমরা ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও সিঙ্গাপুর যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করি। দিনে ৫০ থেকে ৬০ জনের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। সন্দ্বীপ ওভারসিজের লোকেরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছে, তারা কয়েকজনের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে চায়।’ সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সন্দ্বীপ ওভারসিজের ঠিকানা বা যোগাযোগের নম্বর চাইলে মোজাম্মেল বলেন, ‘আসলে আপনাকে বেশি তথ্য দিতে পারছি না।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক শামসুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ একটু সচেতন হলেই যেকোনো ধরনের প্রতারণা থেকে মুক্ত হতে পারে। সরকারের নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান কাউকে চাকরি দিয়ে বিদেশে পাঠাতে পারে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশে চাকরির কথা বলে, তখনই ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নম্বর জানতে চাওয়া উচিত। ব্যুরোর আরেক কর্মকর্তা বলেন, যদি মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষা ছাড়া কেউ এ রকম চাকরির অফার লেটার পাঠায়, তাহলে যাচাই-বাছাই করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানে চাকরির কথা বলা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না; থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সরকারি অনুমোদনসহ বিভিন্ন বৈধতা যাচাই করতে হবে।