ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে মন্দ ঋণ অবলোপনের হিড়িক পড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলো হিসাবের খাতা থেকে প্রায় ৭০০০ কোটি টাকা ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ৩২,১১০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৫,৩২৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ৬,৭৮২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সার্বিকভাবে অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৩০,৭২৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১,৩৪৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে বিতরণকৃত ঋণের ১০.৭৫% খেলাপি। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা একপর্যায়ে আদায় করতে না পেরে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে অবলোপন করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছর অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে। বছরের পর বছর ধরে থাকা মন্দ বা ক্ষতিজনক পর্যায়ের খেলাপি ঋণ একপর্যায়ে ব্যাংকের স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। ঋণ অবলোপনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০০৩ সালে একটি নীতিমালা তৈরি করে। নীতিমালার আওতায় ৫ বছর ও তার বেশি সময় ধরে অনাদায়ী থাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ ভাগ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে ওই ঋণ অবলোপন করা হয়। অবলোপন করা ঋণের হিসাব ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে সরিয়ে আলাদাভাবে হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। এসব ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের আলাদা ইউনিট থাকে। মূলত এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ের একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মন্দ ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হওয়ায় এসব ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলো মন্দ বা ক্ষতিকর ঋণ অবলোপন করে তা অনেকটা অস্বচ্ছ। এভাবে হিসাবের খাতা থেকে ঋণ বাদ দেয়া ব্যাংকিং খাতের জন্য ভাল নয়। তবে ব্যাংকারদের ধারণা, মন্দ ঋণ অবলোপন ব্যাংকিং খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বছরের ছয় মাস শেষে (জানুয়ারি-জুন) রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫,৪৮৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে যা ছিল ১৪,৮২২ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের তুলনায় ৬৬৩ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের জুনে যার পরিমাণ ছিল ১০,৭২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক জুন পর্যন্ত অবলোপন করেছে ৬,০৪৩ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক অবলোপন করেছে ৩,৩৬৮ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক ৫,০৫৩ কোটি ও রূপালী ব্যাংকে আগের প্রান্তিকের মতোই ১,০১৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন রয়েছে ১২,৭৬৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এটার পরিমাণ ছিল ১২,২৪১ কোটি টাকা। এক বছর আগে জুনে ছিল ১০,৯৭২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবলোপনের তালিকায় রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২,০০৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আইএফআইসি ব্যাংক অবলোপন করেছে ১,২১১ কোটি টাকা ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিটি ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ১,০৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া উত্তরা ব্যাংকে অবলোপন করা হয়েছে ৮৭২ কোটি টাকা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৮৪৩ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ৮৪৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ৭৯৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে ৩,৪১৮ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশী ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন বেড়ে ৪৩৮ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ক্ষুদ্রঋণের বিপরীতে মামলা করতে অনেক সময় ব্যাংকের ঋণের চেয়ে টাকা বেশি খরচ হয়। এজন্য ৫০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে মামলা না করে অবলোপনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে অনেক ব্যাংক ছোট মাত্রার ঋণ অবলোপন করেছে।