গত সোমবার আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় প্রকাশের পর রিভিউ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে বুধবার সন্ধ্যায় আনিসুল হক তার বাড়িতে সাংবাদিকদের একথা জানান।
যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের বিষয়টি নজির হিসেবে তুলে ধরে মন্ত্রী বলছেন, জামায়াতের এই নেতার দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে আইনি কোনও বাধা নেই।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর তা পর্যালোচনায় আবেদন জানানোর কথা জামায়াত নেতার আইনজীবীরা বলে এলেও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্যও অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের সামনে এসে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হকও বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।
“এখন পর্যন্ত একটা রায় (আব্দুল কাদের মোল্লার রায়) আছে, যেখানে রিভিউ পিটিশন ডিসমিসড হয়ে রায় কার্যকর হয়েছে। আমাকে সেটা ধরে নিয়ে রায় কার্যকর করার প্রস্তুতির আদেশ দিতে হবে। আমি সেই আদেশ দিয়েছি।”
“আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে বলব, ফাঁসির রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার, সেগুলো (নেওয়ার) জন্য,” বলেন আইনমন্ত্রী।
আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের আগে সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে আসেন তার পরিবারের সদস্যরা। এতে এই জামায়াত নেতার দণ্ড কার্যকর নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়।
তবে দেখা করে বেরিয়ে কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, এটাকে শেষ দেখা ভাবছেন না তারা।
কামারুজ্জামানের আগে তার দলেরই নেতা কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় হয়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
কাদের মোল্লার আপিলের রায় হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তার প্রায় আড়াই মাস পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ।
এরপর ৮ ডিসেম্বর দুই পৃষ্ঠার একটি ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে করে এবং লাল কাপড়ে মোড়ানো ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ রায়ের কপি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
১০ ডিসেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগে সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। জামায়াত নেতা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ নেননি।
ওই দিন রাত ১২টা ১ মিনিটেই মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ রাতে এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করেন।
ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হয়। এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর শুনানি শেষে তা নাকচ হয়ে যায়।
এরপর ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা। এরপর রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, যেহেতু কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেছে, সেহেতু কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
“একটা প্রশ্ন থাকতে পারে যে এ রায় রিভিউ করতে পারে কি না। এর আগে একটা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। সেই মামলায় একটা রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল, যা আপিল বিভাগ রিজেক্ট করে দিয়েছিল, ডিসমিস করে দিয়েছিল।”
“সেইক্ষেত্রে আমরা ধরে নেব, পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা না করা পর্যন্ত রিভিউ করা যাবে না। পূর্ণাঙ্গ রায় অন্য কিছু হলে আলাদা কথা। তবে এই ক্ষেত্রে আমরা ধরে নেব যে এরকম একটা নজির আছে যে রিভিউ পিটিশন মহামান্য আপিল বিভাগ দেন নাই।”
অ্যাটর্নি জেনারেলসহ প্রসিকিউটরার আগে থেকেই বলে আসছিলেন, বিশেষ আইনে এই বিচারে আসামির রিভিউ আবেদন করার কোনও সুযোগ নেই।
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বুধবারও বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে তারা সেই আবেদন করবেন।
তবে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল উভয়ই রিভিউ আবেদনের সুযোগ নেই দাবি করার পাশাপাশি দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রয়োজন নেই বলে মত প্রকাশ করেন।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায় কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে আনিসুল হক বলেন, “আপনি জেল কোড মানেন অথবা না মানেন, কোথাও কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ের কথা লেখা নাই। যেটা আছে সেটা হল, শর্ট অর্ডারের কথা। শর্ট অর্ডারটা পেলেই হয়ে যাবে।”
তবে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ কামারুজ্জামানও পাবেন বলে মন্ত্রী জানান।
রায়ের সাত দিনের মধ্যে এই আবেদন করতে হয় বলে কারাবিধিতে রয়েছে। কাদের মোল্লা এই সুযোগ নেননি বলে তার দণ্ড কার্যকরের আগে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন।
আনিসুল হক বলেন, কামারুজ্জামানকে তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনা চাইতে হবে।
আসামি কামারুজ্জামান আনুষ্ঠানিকভাবে রায় জেনেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি ডিআইজিকে জিজ্ঞেস করিনি যে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রায় জেনেছেন কি না। তবে যতদূর জানি, তিনি জেনেছেন তাকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে।”
ক্ষমা চাওয়ার আবেদনের সময়ের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, “সংবিধানে এরকম কোনও সময় দেওয়া নাই যে, সাতদিনের মধ্যে বা একদিনের মধ্যে…সেই সময়টুকু আমি একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বুঝি, সেটা হলো একটা পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
“পর্যাপ্ত সময়ের কথা যদি খুঁজতে চাই, তাহলে জেল কোডে সাতদিনের কথা বলা হয়েছে। সাতদিনের বেশি সময় থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে না।”
তবে সব কিছুর পর আইনসম্মতভাবেই আসামির দণ্ড কার্যকর হবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।
একাত্তরে মানতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৯ মে দেওয়া রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে গত ৩ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়েও তার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
রায়ের পর কামারুজ্জামানকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় আনা হয়।
Source: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম