সিলেট ও রংপুরে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাত দফা দাবিতে সিলেট বিভাগ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক্যপরিষদ ধর্মঘটের ডাক দেয়। অপরদিকে রংপুরে একজনের মৃত্যু ও এর জের ধরে পরিবহন নেতার বাসায় হামলার প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল।
সিলেট অফিস জানায়, ১২ ঘণ্টা পর সিলেট বিভাগে ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে এক সমঝোতা বৈঠকে ধর্মঘট স্থগিত করা হয়। বৈঠক শেষে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক মানবজমিনকে জানিয়েছেন, দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হলে ধর্মঘট স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি জানান, আজ থেকে ঘোষিত দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এ কারণে ধর্মঘটী শ্রমিকরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সাত দফা দাবিতে সিলেটে আন্দোলন চালিয়ে আসছে সিলেট বিভাগ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক্যপরিষদ। একই দাবিতে ১৫ দিন আগে তারা সিলেটে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করেছিল। ওই সময় সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকে ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছিল। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকে তাদের দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু বৈঠকের পর সেটি কার্যকর করার কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ কারণে ফের ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। ওদিকে, শনিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ধর্মঘটের কর্মসূচি ঘোষণার পর সোমবার সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার সাজ্জাদুল হাসান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু মালিক নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, ওই বৈঠক সম্পর্কে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে কোন চিঠি চালাচালি করা হয়নি। এ কারণে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকে যোগ দেননি। এর প্রেক্ষিতে গতকাল সকাল থেকে সিলেট বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট শুরু করা হয়েছিলো। ধর্মঘট চলাকালে সকাল ১০টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। সিলেট থেকে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ ছিল। এ কারণে লোকজন চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। নগরীতে যথারীতি সিএনজি অটোরিকশা চলছে। সিলেট বিভাগীয় মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জমির মিয়া জানিয়েছেন, সিলেট জেলায় শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। শ্রমিকরা বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পিকেটিং করছে। তিনি বলেন, ৭ দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। এদিকে পরিবহন ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছিল সিলেট বিভাগ। এতে যাত্রী দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। আগে থেকে বুকিং করে রাখা গ্রিনলাইন সহ বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক বাস সার্ভিসের টিকিট ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে সন্ধ্যায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর সিলেট থেকে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যানবাহন ছেড়ে গেছে। সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢালাওভাবে সিএনজি অটোরিকশা ও হিউম্যান হলারের রোড পারমিট বন্ধ, অটোরিকশার সামনের সিটে যাত্রী পরিবহন বন্ধ, অটোরিকশার চালকের উভয়ের পাশে গ্রিলের বেষ্টনীর ব্যবস্থা, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মহাসড়কে থ্রি-হুইলার ও ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চলাচল বন্ধ, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও গাড়ি রিক্যুইজেশনের নামে হয়রানি বন্ধ করা। সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জানিয়েছেন, গতকালের বৈঠকে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার সাজ্জাদুল হাসান, ডিসি শহিদুল ইসলাম ছাড়াও অপর তিন জেলার জেলা প্রশাসকরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া মালিক- শ্রমিক ঐক্যপরিষদের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সব ক’টি দাবি পূরণে তারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এদিকে, সিলেট জেলা অটোটেম্পো ও অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকারিয়া জানান, ধর্মঘটে সিএনজি অটোরিকশা যথারীতি চলাচল করছে। কেউ এতে বাধা দিলে তাদের প্রতিহত করা হবে। তিনি জানান, যাত্রীদের জিম্মি করে অযৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জেদান আল মুসা জানান, সিলেটে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়েছে। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও যথারীতি সিএনজি অটোরিকশা, ইজিবাইক ও অটোটেম্পো চলাচল করছে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল।
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, টোল আদায়কারী ইমরান মোটর শ্রমিকদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর উত্তপ্ত রংপুরের পরিস্থিতি। আধিপত্য বিস্তার এবং টোল আদায়কে কেন্দ্র করে মোটর মালিক ও মোটর শ্রমিকদের বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকা- হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকাল মাহিগঞ্জ সাতমাথায় মোটর মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের দু’পক্ষের লাঠি, ছোরা, রামদা, কুড়ালসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। দু’পক্ষের সংঘর্ষে সাংবাদিক, পথচারী, পুলিশসহ প্রায় ৫০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় রংপুর নগরজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সহিংসতা এড়াতে মোড়ে মোড়ে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। তবে সন্ধ্যায় তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মিয়াকে সোমবার রাত ৩টার দিকে সাতমাথা এলাকায় ৮-১০ জন সন্ত্রাসী হামলা করে। এ সময় চাপাতির কোপে ইমরানের দু’হাত অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লোকজন তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিক্ষুব্ধরা মিছিল নিয়ে সাতমাথা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে তাজহাট এলাকায় অবস্থিত পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশনের রংপুর বিভাগীয় এবং মহানগর আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এমএ মজিদের বাড়িতে হামলা চালায় এবং ব্যাপক ভাঙচুর করে। মজিদের ভাবি রংপুর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফরিদা কালামের বাড়িও ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ইমরান হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে তার সমর্থকরা সকাল ৭টায় রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় ১০টি বাস, ৫টি পিকআপ ভ্যান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সংবাদ পেয়ে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পদক এমএ মজিদের সমর্থকরা পাল্টা হামলা চালায়। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। এ সময় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ব্যবসা, বাণিজ্য, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষজন। দফায় দফায় চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে র্যাব ও ফায়ার সার্ভিস ছুটে আসে। এসব দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সময় চ্যানেল আই’র ক্যামেরাম্যান এহসানুল হক সুমনের ওপর শ্রমিক নেতা মজিদের সমর্থক একদল সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে মারধর করে ক্যামেরা ভাঙচুর করে। এ সময় তার কাছ থেকে ক্যামেরা, লাইট, মোবাইল ফোন এবং টাকা নিয়ে যায় তারা। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সহ বিভিন্ন ক্লিনিকে নেয়া হয়। মালিক-শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনায় শ্রমিকরা রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুরসহ ৮ জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করে।
এদিকে সংঘর্ষের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সময় চ্যানেল আই’র ক্যামেরাম্যান এহসানুল হক সুমন ও যুগান্তরের ক্যামেরাম্যান সাঈদের ওপর হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, ক্যামেরা ও ছিনিয়ে নেয়া অন্যান্য মালামাল উদ্ধারের জন্য পুলিশ প্রশাসনের প্রতি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। এ সময়ের মধ্যে প্রশাসন সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারসহ ক্যামেরা ও ছিনিয়ে নেয়া অন্যান্য মালামাল উদ্ধার না হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানানো হয়।