না, হতাশা বা শঙ্কার কোনো কারণ নেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব খুব নীরবেই ঘটছে। মান্দাতা আমলের সংস্কারকে ঝেড়েঝুড়ে বর্জন করে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সংস্কারকে গ্রহণ করছে। তা কেমন? এটা উদাহরণ দেয়া যাক। একটা সময় রেডিও শোনাটাকে হারাম ভাবা হতো। এই ভাবনাটা ছড়িয়েছে মোল্লা-মৌলবিরা। শৈশবে এক ওয়াজ মাহফিলে রেডিওর ব্যবহার সম্পর্কে জনৈক মৌলবিকে বলতে শুনেছিলাম, তিনি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, ‘পুঁটি মাছ খাওয়া হালাল, আর ধোড়া সাপ খাওয়া হারাম। পুঁটি মাছটাকে যদি কোনো ধোড়া সাপ জ্যান্ত গিলে আবার উগরে দেয়, সেই মাছটা খাওয়াও হারাম। কেননা হালাল প্রাণীটা হারাম প্রাণীর সংস্পর্শে গিয়ে হারাম হয়ে গেছে। একইভাবে কোরান তেলাওয়াত শোনা পুণ্যের কাজ। কিন্তু ওই তেলাওয়াতটা যখন রেডিওর মাধ্যমে শোনা হয় তখন সেটা আর পূর্ণকর্ম থাকে না।’
এভাবে মধ্যযুগীয় ভাবাদর্শীরা রেডিওর বিরুদ্ধে নানা ফতোয়া দিয়েও বাঙাল মানুষকে রেডিও শোনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। রেডিওকেন্দ্রিক তাদের হালাল-হারামের প্রকল্পটা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে। টেলিভিশনকেও মোল্লা-মৌলবিদের এমন সব ফতোয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করে বাঙালি-মানসে ঠাঁই করে নিতে হয়েছে, হচ্ছে। গ্রাম বাংলায় বাড়িতে টেলিভিশন রাখাটাকে একসময় গর্হিত কাজ হিসেবে ভাবা হতো। বিশেষ করে মোল্লা-মোলবিদের বাড়িতে। এখন আমজনতা তো বটেই, সেসব মোল্লা-মৌলবিদের বাড়িতেও টেলিভিশন ঢুকে পড়েছে, ঢুকে পড়ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে ডিশ এন্টেনা। গ্রামীণ সংস্কৃতিটাকে বদলে দিচ্ছে ডিশসংস্কৃতি। সিনেমা হলের বিরুদ্ধেও ফতোয়া এসেছে, ফতোয়া এখনো জারি আছে। কিন্তু গত শতকের শেষপাদে আমাদের কৈশোরে দেখেছি মাদ্রাসার ছাত্ররাই টুপিটা পকেটে ঢুকিয়ে, পাঞ্জাবিটা পায়জামা বা লুঙ্গির ভেতরে গুঁজে দিয়ে অথবা পাঞ্জাবির বদলে গোলগলার একটা গেঞ্জি পরে টুপ করে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ছে। মাদ্রাসা ছাত্রদের সিনেমার প্রতি প্রবল আকর্ষণ এখনো জারি আছে। সনাতন ভাবাদর্শী ওস্তাদদের কঠোর শাসন তাদের আকর্ষণকে দমাতে পারছে না। পারবেও না। কেননা নতুনের প্রতি, ব্যতিক্রম কিছুর প্রতি মানুষের কৌতুহল তো মজ্জাগত। একইভাবে মোবাইলকেও কিন্তু এই মোল্লাসংস্কৃতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিছুটা হলেও। প্রথম যখন মোবাইল এলো তখন মৌলবিদেরকে মৌবাইল ব্যবহারের ব্যাপারে দারুণ সংশয়ী দেখা গেল। এখন তো খতমের দাওয়াত নিতেও মোবাইলের ব্যবহার লক্ষণীয়। বহু মাদ্রাসা ছাত্রকে এখন মোবাইলে ফেইসবুক ব্যাবহার করতে দেখা যায়। শুধু ফেইসবুক নয়, কেউ কেউ পর্ণোগ্রাফিও দেখছে।
কিংবা নারী শিক্ষাকেও হারাম ভাবা হতো। আর এখন? এখন নারী শিক্ষাকে কেউ হারাম বললে আমজনতা তাকে গণধোলাই দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নারী নেতৃত্বের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। এক সময় নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফতোয়ার কথা শোনা যেত। ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’―কট্টরপন্থী জামায়াত নেতাদের মুখে এমন কথা তো এই সেদিনও শোনা গেছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও ওয়াহাবি বা খারেজি বা হেফাজতপন্থী মৌলবিরা নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওয়াজ করে মাহফিলের স্টেজ গরম করে ফেলত। অথচ তারাও এখন নারী নেতৃত্ব হারাম কথাটি আর বলে না। কারণ এসব ফতোয়া অচল হয়ে গেছে। পাবলিক আর খায় না। এখন নারীকেই আমির বা নেতা মেনে মোল্লা-মৌলবিরা তাদের নানা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করছে। তার মানে নেতৃত্বের ব্যাপারে নারী-পুরুষের বিভেদটা দূর হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। অপরদিকে, সুদ ইসলামে হারাম ছিল। হয়ত এখনো হারামই আছে। কিন্তু সমকালীন বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি তথা কোরআনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সুদকে হালাল করা হয়েছে। ‘মুদারাবা’ ‘তাফাকুল’ ‘আমানত’ ইত্যাদি নামে ইসলামি ব্যাংকিং, ইসলামি ইন্সুরেন্স কার্যক্রম চালু হয়েছে। তার মানে ইসলামও তার আদি রূপটা বা মৌল নীতিগুলো ধরে রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদি সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইসলাম তার আদি খোলসটা বদল করে নিচ্ছে।
পয়লা বৈশাখে কয়টা মানুষ জড়ো হতো রমনার বটমূলে? শাহবাগ বা চারুকলায় বৈশাখের কোনো অনুষ্ঠান কি আদৌ হতো? হলেও এত বৃহত্তর পরিসরে তো হতো না। আর এখন? সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের উদ্যেগে পয়লা বৈশাখ কি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অবয়ব লাভ করেনি? জেএমবির বোমা হামলা কি তা দমাতে পেরেছে? পারেনি তো। কোনোদিনও পারবে না।
তার মানে বাংলাদেশের সমাজিক সংস্কৃতিটা ভাঙ্গছে, পরিবর্তন হচ্ছে। এই ভাঙ্গন, এই পরিবর্তন অবশ্যই ইতিবাচক। মোল্লা-মৌলবিরা মধ্যযুগীয় যে সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করতে চাইছে, তা তারা কিছুতেই পারছে না। আধুনিক প্রাযুক্তিক সংস্কৃতির কাছে তারা বারবার হেরে যাচ্ছে। পর্যদুস্ত হচ্ছে। যেসব কট্টরপন্থী মোল্লা-মৌলবি সমাজের এই পরিবর্তনটাকে, সংস্কৃতির এই বিপ্লবটাকে মেনে নিতে পারছে না তারা হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী, হয়ে পড়ছে উন্মূল। মূলত এই উন্মূলতা থেকেই জঙ্গীবাদের উত্থান। যত যাই হোক, সামাজিকভাবে কিন্তু জঙ্গীরা প্রতিষ্ঠিত নয়। বাংলাদেশের মানুষ যতই ধর্মভীরু হোক, তারা কিন্তু কট্টরপন্থী জঙ্গীদের মনেপ্রাণে ঠাঁই দিচ্ছে না। ফলে জঙ্গীরা আন্ডারগ্রাউন্ড পলিসি বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অপতৎপরতা চলছে গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। জঙ্গীদের জঙ্গী তৎপরতা গ্রামবাংলার লোকসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কোনা সম্ভাবনা নেই। কেননা মানুষ এখন প্রযুক্তি নামের যে অমৃতের সন্ধান পেয়েছে বা পাচ্ছে, তাকে বিসর্জন দিয়ে সনাতনপন্থী ওসব জঙ্গীপনাকে কোনোভাবেই প্রশয় দেবে না। দিলেও তা দ্রুতই প্রত্যাহার করে নেবে। সুতরাং এদেশে জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে, মোল্লা-মৌলবিরা একচেটিয়া আধিপত্যের অধিকারী হবে কিংবা এ দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম হবে―এমন আশঙ্কা করার কোনো কারণ নেই। অন্তত আমি শঙ্কিত নই।
সুতরাং হতাশা বা শঙ্কার কোনো কারণ নেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তো হচ্ছে। এই বিপ্লবটাকে আরো এগিয়ে দিতে হবে। কেউ হয়ত প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই বিপ্লব তো বুর্জোয়া বা সাম্রাজ্যবাদী বা পুঁজিবাদী বা পণ্যসংস্কৃতির বিপ্লব। হোক না। অসুবিধা কি? এই সংস্কৃতি তো সনাতন মধ্যযুগীয় কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংস্কৃতির চেয়ে খারাপ নয়। বরং অনেক অনেকাংশে ভালো। এই পণ্যসংস্কৃতিই তো ভেঙে দিচ্ছে কট্টরপন্থীদের সমস্ত ভাবাদর্শ, পুরাতন যত সংস্কার। এখন শুধু প্রয়োজন সাধারণ শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। সাধারণ শিক্ষা মানে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক শিক্ষা; যে শিক্ষা মানুষকে সমকালীন বাস্তবতা সম্পর্কে বুঝতে শেখাবে। যে শিক্ষা বুঝতে শেখায় মানুষ তথাকথিত ঈশ্বরপুত্র নয়, মানুষই ঈশ্বর। মানুষ যখন এই শিক্ষায় শিক্ষিত হবে তখন সে নিজ থেকেই তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য উদগ্রীব হবে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার―হোক সেটা বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা―আমূল পরিবর্তন চাইবে। পরিবর্তন না ঘটলে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা ঘটাবে। হয়ত সেই বিপ্লবটাই হবে বহুল প্রত্যাশিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।