রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলের ছাত্রী ঝুমুর। অংশ নিচ্ছে এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়।
১০ বছর বয়সেই পাবলিক পরীক্ষায় লড়ছে এ শিশুটি। পুরো বছর কোচিং-ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে কেটেছে ব্যস্ততায়। মেলেনি একটুও বিশ্রাম। খেলাধুলার সুযোগ পায়নি বা দেওয়া হয়নি। পরীক্ষায় পাস করা বা ভালো ফল করার প্রস্তুতি শুরু হয় বছরের শুরু থেকেই। স্কুলগুলোতে শুরু হয় কোচিংয়ের নামে বাড়তি পড়াশোনা। পড়া মুখস্থ করানোর জন্য স্কুলে শিক্ষকের চাপ, বাসায় মা-বাবার চাপ। শহর কিংবা গ্রাম- সবখানে একই চিত্র। চলমান শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতেই একজন শিক্ষার্থীকে বসতে হচ্ছে চারটি পাবলিক পরীক্ষায়। পরীক্ষার এই বোঝার কারণে পড়ালেখা নিয়েই ভীত হয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা।
বিরামহীন পরীক্ষার ভারে ভীত হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাহাত জানায়, ‘সারাক্ষণ বই পড়তে হয়। সারা বছরই পরীক্ষা। স্কুলে যেতে হয়, কোচিং ক্লাস করতে হয়। কোথাও ঘুরতে যেতে পারি না। খেলাধুলার সময় কোথায়?’
পরীক্ষা মানেই ভীতি!
চারটি পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার চাপে দিশাহারা শিক্ষার্থীরা। অতিষ্ঠ অভিভাবকরাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা না করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক পরীক্ষা।
রাজধানীর একটি নামকরা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গোটা শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে কি না তা ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নির্বিকার।’
পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য এলাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। এটি শিশুদের মনে চাপ সৃষ্টি করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, ‘অন্য স্কুলে গিয়ে অপরিচিত পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়ার ফলে শিশুমনে চাপ তৈরি হয়।’
মইনুল হাসান নামের একজন অভিভাবক বলেন, ‘গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়ি যাবে। হইচই করে নিশ্চিন্তে কিছুদিন আনন্দ করবে। খেলবে, সাঁতার কাটবে। এসব কথা বোধ হয় এখনকার ছেলেমেয়েরা চিন্তাও করতে পারে না। কারণ তাদের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় পরীক্ষাভীতি দিয়ে।’
সামিয়া হোসেন নামে একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় পিএসসি ও জেএসসি ছিল না। ছুটির দিনগুলোতে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। এভাবেই লেখাপড়ার বাইরেও জীবনের বাকি অংশগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছি। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে সেটা রূপকথার মতো।’
রাজধানীর অগ্রগামী শিশু নিকেতনের শিক্ষক দুর্গা রানী বাছাড় বলেন, ‘পিএসসি ও জেএসসি আমাদের সন্তানদের জীবনে শুধু দুটি সার্টিফিকেট যোগ করতে পেরেছে। বিনিময়ে কেড়ে নিচ্ছে ওদের সুন্দর ও প্রাণবন্ত শৈশব ও কৈশোর।’
এত সনদের দরকার আছে কি?
পিএসসি, জেএসসি সনদের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বা আদৌ এর কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। আগে কিছু কিছু চাকরিতে পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণি পাসের যোগ্যতা চাওয়া হতো। সে ক্ষেত্রে স্কুলের সার্টিফিকেটই যথেষ্ট ছিল। এখন আমাদের দেশে যেকোনো চাকরির জন্য এইচএসসি, এমনকি ডিগ্রি পাস লোকেরও অভাব নেই।
কোচিং আর প্রাইভেট শিক্ষক গিলিয়ে দিচ্ছে কী করে ভালো ফল করা যায়। ফল ভালো হচ্ছে; কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ বোঝা যাচ্ছে না। মেধারও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ হচ্ছে না। বাড়ছে শিক্ষা ব্যয়। অব্যাহত পরীক্ষার চাপ সামাল দিতে শিশুরা গাইড বই ও প্রাইভেট টিউশনির দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ছে। আবুল হাসান নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘এখন কে কোন গ্রেড পেল, কে জিপিএ ৫ পেল অভিভাবকদের কাছে এ বিষয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক- সবার চোখ শিক্ষা নয়; বরং পরীক্ষার দিকে।’
শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক!
জানা গেছে, ২০০৯ সালে যখন হঠাৎ প্রাথমিক পরীক্ষা চালু করা হয়, তখন নবগঠিত শিক্ষা কমিশন শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ করছিল। শিক্ষানীতির জন্য অপেক্ষা না করেই পিএসসি পরীক্ষা চালু করে দেওয়া হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বাধ্য করার পদ্ধতি চালু করার আগে এর উদ্দেশ্য ও প্রয়োগ সম্পর্কে যেসব গবেষণা হওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি বলে মনে করেন নাহিদুল ইসলাম নামের একজন অভিভাবক। ১০ থেকে ১১ বছরের শিশুদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারটা আসলে পৃথিবীর কোথাও নেই বলে জানান শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘অন্য কোনো দেশে এতগুলো পাবলিক পরীক্ষা চালু আছে কি না আমার জানা নেই।’
শিক্ষানীতি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি জানান, ‘শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি কিন্তু মোটেও চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেনি, তারা মাত্র দুটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেছে- একটি অষ্টম শ্রেণির শেষে, আরেকটি দ্বাদশ শ্রেণির শেষে। তাহলে আমরা কেন চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষা নিচ্ছি? ব্যাপারটা বোঝার জন্য এবার আসল শিক্ষানীতির দিকে তাকাতে হবে। দেশের শিক্ষাবিদরা যে শিক্ষানীতি জমা দিয়েছেন, তার ওপর ছুরি চালিয়েছেন আমাদের আমলারা।’
গুলশান কমার্স কলেজের শিক্ষক লুনা পারভীন বলেন, ‘দেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি প্রণীত হলো, অথচ সেটি বাস্তবায়নে কারো মনোযোগ নেই। সবাই শুধু পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সবার ওপরে পরীক্ষা সত্য তার ওপরে নাই।’
সমাধান কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মুহাম্মদ নাজমুল হক বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষাটার আসলে দরকার নেই। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বয়স অনেক কম থাকে। এই পরীক্ষা ওদের জন্য একটা মানসিক চাপের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণও আমাদের পরীক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাই পরীক্ষাটাকে এত সিরিয়াসলি নেন, যে কারণে ছেলেমেয়েদের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘পরীক্ষার সংখ্যা কমানোই ভালো। পিএসসি ও জেএসসির এই সনদগুলো কোনো কাজে দেবে না। মাঝখান থেকে এই পরীক্ষাগুলো ব্যয়সাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষও বটে। যত বেশি পরীক্ষা হবে তত বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ তৈরি হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ভীতি বাড়বে। এত পরীক্ষা তো আগে ছিল না। এত পরীক্ষার আদৌ দরকার আছে বলে মনে হয় না। অন্তত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেওয়া দরকার।
Posted by Ab Emon