১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ছিল শুক্রবার। ঢাকায় কারফিউ চলছে। বিদ্যুৎ নেই। পুরো ঢাকা অন্ধকার। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল (রূপসী বাংলা হোটেল) ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে নিরাপদ জোন ঘোষণা করা হয়। বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকেরা এখানে আশ্রয় নেন।
এদিন ভারতীয় মিত্রবাহিনী ঢাকার রেডিও অফিস বোমা মেরে ধ্বংস করে। বন্ধ হয়ে যায় সম্প্রচার। বোমাবর্ষণ চলে চট্টগ্রামে ও চালনা বন্দরে। সকাল থেকে তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলে চালনায়। কমপক্ষে দশটি জাহাজ ধ্বংস হয়।
একাত্তরের আজকের দিনে লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনায় প্রচণ্ড লড়াই হয়। রংপুর ও দিনাজপুরের পাকিস্তান সেনারা বগুড়া ও রাজশাহী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাতে বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। লাকসাম মুক্ত হয়। সেখানে প্রায় ৫০০ পাকিস্তানি সেনাসহ কমান্ডিং অফিসার আত্মসমপর্ণ করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ক্যাম্পের সৈন্যরা তখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিল। হঠাৎ করে ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়ার খবর তাদেরও জানানো হয়নি ক্যাম্প থেকে। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এসব পাকিস্তানি সৈন্য বিভিন্ন এলাকায় আত্মসর্পণ করতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে, পাকিস্তানিদের পরাজিত করে সর্বত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধারা উড়াচ্ছে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দোসর আলবদর-রাজাকাররা শেষ আঘাত হানছে। হত্যা ও ধ্বংসের বিভীষিকার তান্ডব চালাচ্ছে ওরা; কিন্তু সব পায়ে দলে এক নদী রক্ত পেরিয়ে বিজয় পতাকা উড়ছে বাংলাদেশের আকাশে।
একাত্তরের এদিন ৫৭ নম্বর ডিভিশন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল মিত্রবাহিনী কিভাবে রাজধানী ঢাকার নদীর বাধা অতিক্রম করে। ভোর থেকে ভৈরববাজারের ৩/৪ মাইল দক্ষিণে হেলিকপ্টার করে নামানো হলো ৫৭ নং ডিভিশনের সৈন্য। সারাদিন ধরে মেঘনা অতিক্রমের সেই অভিযান চলে। প্রথম বাহিনীটা ওপারে নেমেই ঘাঁটি গেড়ে বসল। কিছুটা উত্তরে ভৈরববাজারের কাছেই তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের বড় একটা মজুদ। ব্রিজটার একটা অংশ ভেঙ্গে দিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে ওত্ পেতে বসে থাকে হানাদাররা।
আকাশে সূর্য উঠতেই তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার। নদী পার হচ্ছে, তা দেখেও হানাদাররা ঘাঁটি ছাড়তে সাহস পেল না। ভাবল ওটা বোধহয় মিত্রবাহিনীর একটি ধাপ্পা। ওদিকে ছুটে গেলেই আশুগঞ্জ থেকে মূল মিত্রবাহিনীটা ভৈরববাজার-ঢাকার রাস্তা ধরবে। সত্যিই কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীকে ভুল বোঝানোর জন্য মিত্রবাহিনী একটা বড় কলাম তখন এমন ভাবসাব দেখাচ্ছিল যে, তারা আশুগঞ্জ দিয়েই মেঘনা পার হবে। পাকিস্তানি বাহিনী এভাবে ভুল বোঝায় মিত্রবাহিনীর সুবিধা হলো একরকম বিনা বাধায় মেঘনা পার হওয়া গেল।
মিত্রবাহিনী অবাক হয়ে দেখল বাংলাদেশের কিছু রাজাকার ছাড়া সব মানুষই স্বাধীনতা চায়। সাহায্য চাওয়া মাত্রই ছুটে আসল হাজারো সাধারণ মানুষ। শত শত নৌকা নিয়ে এলো তারা। সে সব নৌকা বার বার মেঘনা পারাপার করল। কয়েক মাইল হেঁটে তারপর তারা পৌঁছেছিল ভৈরববাজার-ঢাকার মূল সড়কে এবং পরদিনই তারা রায়পুরা দখল করে নিল। ওদিকে তখন উত্তরের বাহিনীটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। ময়মনসিংহের কাছে তারা দাঁড়াল। খবর ছিল যে, ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনীর একটা ব্রিগেড রয়েছে কিন্তু সে ব্রিগেডকে অনেক আগেই যে ভৈরববাজারের দিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তা মিত্রবাহিনী জানত না। তাই মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহে বড় লড়াই করার জন্য সেদিনটা ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে শম্ভুগঞ্জে অপেক্ষা করল।
একটা জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়েও কিছু পাকিস্তানি সেনা সিঙ্গাপুরের দিকে যাচ্ছিল। সব ধরা পড়ল মুক্তিপাগল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
১৯৭১ সালে আজকের দিনে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত রুহুল আমিন শাহাদতবরণ করেন। বাংলাদেশের গানবোট পদ্মা ও পলাশ মংলা বন্দর হয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে বিমান হামলার শিকার হয়। বহু নাবিক শাহাদতবরণ করেন এ হামলায়। এর মধ্যে ইঞ্জিনরুম আর্টিফিশার অফিসার রুহুল আমিন অন্যতম। অপারেশন হট প্যান্টস সাঙ্কেতিক নামে একটি অভিযানের জন্য যাচ্ছিলেন তারা। এর লক্ষ্য ছিল খুলনা ও মংলা এলাকায় শত্রুপক্ষের নৌযানের ওপর আঘাত হানা এবং পশুর নদীর মোহনায় মাইন স্থাপন করা।
১৯৭১ সালের আজকের দিনে যুদ্ধপরিস্থিতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়ায় তাতে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে পরাজয়ের স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে যায়। আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলে পাকিস্তান শিবিরে। জাতিসঙ্ঘ থেকেও সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, সাধারণ পরিষদ গৃহীত যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাকিস্তান মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিন ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের সাথে ভারতে বাংলাদেশী ১ কোটি শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি হয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারের মুখপাত্র জানান, দুই দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে এ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বলেন, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি বা গ্রহণও করেনি।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজয় শুধু তখনই সম্ভব হবে যখন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হবে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত এক কোটি শরণার্থী তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবে।
Post by Usman gony