ছাত্রদলের নিষ্ক্রিয়তায় রাজপথের আন্দোলনে প্রায় গতিহীন বিএনপি। কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব, চেইন অব কমান্ড ধরে না রাখা, অর্থবিত্তের দিকে ঝুঁকে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনে। ফলে চূড়ান্ত আন্দোলনের সফলতা থেকে দলটি ছিটকে পড়ে। ছাত্রদলকে চাঙ্গা করা না গেলে ভবিষ্যৎ আন্দোলনে সফল হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদলকে চাঙ্গা করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সফল ছাত্রনেতারা আবারও সক্রিয় হচ্ছেন। আজ ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ছাত্র কনভেনশন। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের মতে, এক সময় এই ছাত্রদলই ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রাণশক্তি। নব্বইয়ে তৎকালীন সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে ছাত্রদের আন্দোলন। সামনে থেকে সেই আন্দোলনকে যে সংগঠনগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ছাত্রদল। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে ছাত্রদলের যেসব নেতা পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি দলের প্রধান। এরপরও আন্দোলন চলেছে, চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েনি। কিন্তু বর্তমানে সেই ছাত্রদলে চেইন অব কমান্ড প্রায় নেই বললেই চলে। কেউ কারও কথা শোনে না। কমিটি গঠন নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। দল নয়, আন্দোলন নয়- শুধু নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছে ছাত্রদলের অনেক নেতা। যে কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হচ্ছে না বলে জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করেন।ছাত্রদল থেকে মূল দলে এসে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন এমন এক নেতা বলেন, ২০০১-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত ছাত্রদলের পতন শুরু হয়। নব্বইয়ের আন্দোলনের পর ৯৬-তেও চাঙ্গা ছিল সংগঠনটি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠ গরম রেখেছিলেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাই। কিন্তু ২০০১-এ ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকেই আর ছাত্রদলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন থেকেই আখের গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সুযোগ বুঝে সরকারি দলের সঙ্গে মিলেমিশে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন অনেকেই। এছাড়া কমিটিতে ভাইতন্ত্রের প্রভাবে অনেক অযোগ্য কর্মী নেতা হয়ে যাচ্ছেন। ফলে সক্রিয় নেতাকর্মীরা আর উদ্যোগী হয়ে কাজ করছেন না। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কথাও শুনতে চাচ্ছেন না। ফলে দলে আগের মতো চেইন অব কমান্ড লক্ষ্য করা যায় না।ছাত্রদলকে চাঙ্গা করা না গেলে ভবিষ্যৎ আন্দোলনে সফল হওয়া সম্ভব নয়। এমন বাস্তবতায় আজ ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ছাত্র কনভেনশন। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই কনভেনশনে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাবেক ও বর্তমান নেতারা অংশ নেবেন। ৯০ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ছাত্র কনভেনশনের আদলেই হচ্ছে আজকের এ অনুষ্ঠান। নব্বইয়ের স্লোগান ছিল- স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্রের মুক্তি আর এবারের স্লোগান হচ্ছে- ফ্যাসিবাদের পতন ও গণতন্ত্র মুক্তির দ্বিতীয় লড়াই। দিনব্যাপী এ কনভেনশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আজকের কনভেনশনকে ঘিরে ছাত্রদলের বর্তমান নেতাকর্মীদের মধ্যেও প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগের প্রশংসা করে ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত রাখার দাবিও জানিয়েছেন তারা।ইতিমধ্যে কনভেনশনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানান অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়। দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করতেই আজকের এ ছাত্র কনভেনশন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা শপথ নেব আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি লড়াই করার। সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে ঘরে ফিরব।তিনি বলেন, যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। নিজেদের কিছু দুর্বলতার কারণে হয়তো ছাত্রদল বিগত সময়ে সেভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আজকের কনভেনশন সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে নতুন সেতুবন্ধন তৈরি করবে যা আগামী আন্দোলনে সহায়ক হবে বলে আশা করেন তিনি।ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রদল যদি আগের মতো ভূমিকা পালন করত তাহলে গত ৫ জানুয়ারি সরকারের পতন হতো। কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার পেছনে কিছু দুর্বলতা তো রয়েছেই। তাছাড়া বর্তমান সরকারের আচরণটাও দেখতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকার রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে যা খুশি তাই করছে। তারা ছাত্রদের বুকে গুলি করতেও পিছু হটছে না। বিগত এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও এমনটা দেখা যায়নি।আন্দোলনের ক্ষেত্রে সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে কোনো দূরত্ব আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো না কোনো জায়গায় তো ঘাটতি আছে। সে কারণে শতভাগ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। আজকের কনভেনশন অনেকটা মতবিনিময় সভার মতো। সেখানে আমাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হবে। এখান থেকে নতুনরা আন্দোলনে উদ্দীপ্ত হবে। যতবার সিনিয়র-জুনিয়ররা একসঙ্গে বসা যাবে সম্পর্ক আরও বেশি জোরালো হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপির এ নেতা।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সময় বড় একটি ধাক্কা খায় বিএনপি, যার প্রভাব পড়ে ছাত্রদলেও। ২০০১ সালের পর ছাত্রদলের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন তারেক রহমান। ওই সময় থেকেই ছাত্রদল তাদের আগের ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। তারেকের নাম ভাঙিয়ে অনেকেই নানা অপকর্ম শুরু করে। অনেক নেতার বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। সংগঠন গোছানোর চেয়ে অর্থের পেছনেই বেশি সময় দিতে শুরু করেন তারা। শুধু টেন্ডারবাজি নয়, নিজ সংগঠনের পদ বাণিজ্যের অভিযোগও ওঠে কারও কারও বিরুদ্ধে। রাজপথে সক্রিয় এবং যোগ্যদের বাদ দিয়ে নিজ অনুসারীদের শীর্ষ পদে বসানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দলের হাইকমান্ডকে ম্যানেজ করে তারা এতে সফলও হন।বিগত ওয়ান-ইলেভেনর সময় তারেক রহমান বিদেশে চিকিৎসা নিতে চলে যাওয়ায় সংগঠনটির দেখভালের দায়িত্ব নেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন পর দায়িত্ব নেয়ায় সংগঠনটির বাস্তব চিত্র জানতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়। এছাড়া একটি গ্র“প তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করছে। আবার অনেকে খালেদা জিয়াকেও ভুল তথ্য দিচ্ছেন। ফলে ভেঙে পড়েছে সংগঠনটির চেইন অব কমান্ড।সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলনে রাজপথে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয় ছাত্রদল। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতারা চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। বিগত কমিটি চরম ব্যর্থতার পর ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। বেশ কয়েক দফা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর থেকে একটি অংশ এর বিরোধিতা করে আসছে। কোন্দলের কারণে দীর্ঘ দুই মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন কমিটি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি। আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের চেয়ে কোন্দল নিরসনেই ব্যস্ত রয়েছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির সিনিয়র নেতা এমনকি খালেদা জিয়াকেও কোন্দল নিরসনে হস্তক্ষেপ করতে হয়। সম্প্রতি কোন্দল নিরসনে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছেন তারা। পদবঞ্চিতদের কয়েকজনকে কমিটিতে কো-অপ্ট করা ও সিনিয়র কয়েকজনকে যুবদল বা অন্যান্য অঙ্গসংগঠনে পদ দেয়ার আশ্বাসে বিদ্রোহীরা আপাতত আন্দোলন থেকে সরে এসেছে।মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কমিটি ঘোষণার পর সংগঠনের একটি অংশ প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে সমঝোতা হলেও আন্দোলনে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। উল্টো বর্তমান কমিটিকে ব্যর্থ করানোর পেছনে কেউ কেউ কাজ করতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের কৌশল চূড়ান্ত করার ওপরই জোর দিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।জানতে চাইলে ছাত্রদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রদল তাদের অতীত ঐতিহ্য পুরোপুরি ধরে রাখতে পেরেছে এটা বলব না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিও দেখতে হবে। সরকার যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রাজপথে সক্রিয় আছেন। তিনি বলেন, ছাত্র কনভেনশন নতুন প্রজন্মের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাবেক ছাত্রনেতাদের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুনদের সহায়ক হবে। সব ভেদাভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে ছাত্রদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা করি।
আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশ নিউজ২৪.com