আনন্দ-বেদনার অনেক উপাখ্যান লিখে বিদায় নিচ্ছে আরেকটি বছর। বছরের শেষ দিনে ২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন আরিফুল ইসলাম
চলছে নতুন বছরে পা দেওয়ার ক্ষণ গণনা। ব্যর্থতা আর গ্লানিগুলোকে পেছনে ফেলে প্রাপ্তিগুলোকে সঙ্গী করে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়। মনে পড়ে, বিদায়ী বছরের প্রথম দিনটি?
ক্রিকেটবিশ্বের ২০১৪ শুরু হয়েছিল ঝড়-বৃষ্টিকে সঙ্গী করে। বছরের প্রথম দিনের ওয়ানডে ম্যাচ নেমে এল ২১ ওভারে। বৃষ্টি থামার পর ছবির মতো সুন্দর কুইন্সটাউন মাঠে শুরু হলো চার-ছক্কার ঝড়-বৃষ্টি। ৩৬ বলে সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দিলেন, শহীদ আফ্রিদির ১৭ বছর পুরোনো রেকর্ড তখন অতীত। নিকিতা মিলারের শর্ট বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে যখন সেঞ্চুরি ছুঁলেন কোরি অ্যান্ডারসন, ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান স্মিথ বলে উঠলেন, ‘গুডবাই শহীদ আফ্রিদি!’
বছরের শেষে এসেও ‘গুডবাই আফ্রিদি’। ক্রিকেট ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে খ্যাপাটে ক্রিকেটার জানিয়ে দিলেন, আগামী বিশ্বকাপ শেষেই বিদায় জানাবেন ওয়ানডে ক্রিকেটকে। সঙ্গে সেই বছর শুরুর দিনটার দুঃখ আফ্রিদির, ‘দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড হারানোটাই ক্যারিয়ারের একমাত্র আক্ষেপ!’ দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে শুরু হওয়া বছর শেষ হতে পারত টেস্টে দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডে। বক্সিং ডে টেস্টে মাত্র ৫ রানের জন্য সেই রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না অ্যান্ডারসনের অধিনায়ক, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ওয়ানডের মতো টেস্টের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডও এ বছর পেয়েছে নতুন নাম। চূড়ান্ত ক্রিকেট বৈপরীত্য একবিন্দুতে মিলে যাওয়ার অদ্ভুত নিদর্শন উপহার দিয়েছে এবার ক্রিকেট, একই বন্ধনীতে ভিভ রিচার্ডস ও মিসবাহ-উল-হক!
তেমনি ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটিতেই বোধ হয় এতটা অবিশ্বাস নেই, যতটা অবিশ্বাস উপহার দিয়েছেন রোহিত শর্মা। একসময় যেটি ছিল বিশ্বজুড়ে মাস্টার ব্লাস্টারদেরও বহু আরাধ্য, সেই ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি ‘ডাবল’ করে দেখালেন ভারতীয় ওপেনার। দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটিকে নিয়ে গেলেন রূপকথাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া একটি সংখ্যায়—২৬৪! আছে আরও এমন কিছু চমকপ্রদ সংখ্যা, আরও কিছু নাম, কিছু মুখ-ছবি, ঘটনার ঘনঘটা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান। বছরটায় পেছন ফিরে তাকালে তবু চলে আসছে মাঠের বাইরের খেলা। বছরের প্রথমভাগে ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তুলেছে দুটি শব্দ, ‘বিগ থ্রি।’ প্রথম আলো নাম দিয়েছে ‘তিন মোড়ল’। অস্ট্রেলিয়া-ভারত-ইংল্যান্ডের বোর্ডের যোগসাজশে পাল্টে দেওয়া হলো বিশ্ব ক্রিকেটের খোলনলচে। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্তা সংস্থা আইসিসির ক্ষমতা আগেও ছিল সীমিত। তিন মোড়ল মিলে আইসিসিকে কার্যত বানিয়ে ফেলল ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। অনেক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা, অনেক হারিয়ে কিছু পাওয়ার তৃপ্তির হিসাব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হলো তিন মোড়লের পরিকল্পনা। আইসিসি প্রেসিডেন্ট আগেও ছিল অনেকটা সাম্মানিক পদ। এখন সেই ‘অনেকটা’ শব্দটিও আর না বসালে চলে। প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি অদ্ভুতভাবে আইসিসির এখন একজন চেয়ারম্যানও আছেন। আইপিএলে গড়াপেটার মূল হোতা হিসেবে আঙুল যাঁর দিকে, দুর্নীতির নানা অভিযোগের সেই স্রোতের মাঝেই চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন এন শ্রীনিবাসন।
তবে মাঠের ক্রিকেটে এত ঘটনা, এত কীর্তি, এত রেকর্ডের ছড়াছড়ি ছিল যে মাঠের বাইরের নোংরা খেলা কিছুটা হলেও আড়াল হয়ে গেছে। বছরের শুরুতেই একই টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরির মাত্র দ্বিতীয় কীর্তি গড়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা। নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন ম্যাককালাম। সেটাও যখন ভারতের বিপক্ষে ইনিংস পরাজয়ের হাতছানি, ৯৪ রানে পড়ে গেছে ৫ উইকেট। এই দুজনের জন্যই বছরটি ছিল সোনালি সাফল্যে মোড়ানো। দেশের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক পঞ্জিকাবর্ষে টেস্টে হাজার রান করেছেন ম্যাককালাম। একটি ট্রিপল আরও দুটি ডাবল সেঞ্চুরির সঙ্গে ১৯৫। সাঙ্গাকারা রান করেছেন বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। টেস্টে বছরের সেরা ব্যাটসম্যান, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড গড়েছেন এই ৩৭ বছর বয়সে এসে! বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখানোর এই দৌড়ে হাসিমুখে ছিলেন ইউনিস খান ও মিসবাহও। দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়া ইনিংসে মিসবাহ ভেঙেছেন দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড।
বাংলাদেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ‘ফাইনাল অভিশাপ’ কাটিয়েছে শ্রীলঙ্কা। টুর্নামেন্টের আগেই টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে। দুজনই পেয়েছেন দারুণ বিদায়ী উপহার। জয়াবর্ধনে পরে বিদায় জানিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটকেও। বিদায়ী বছরেও ছুঁয়েছেন হাজার রান! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঠিক আগে বাংলাদেশে এশিয়া কাপও জিতেছে শ্রীলঙ্কা, ছুঁয়েছে টুর্নামেন্টে ভারতের পাঁচ শিরোপার রেকর্ড।
অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে ধবলধোলাই করে দুঃসময় পেরিয়ে আবার আলোতে অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড পরে ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়ে বাতিল করে দিয়েছে দলের মহাতারকা কেভিন পিটারসেনকে। বাংলাদেশের চরম ব্যর্থতার বছরটিও উজ্জ্বল দারুণ দুটি ব্যক্তিগত অর্জনে। একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেটের মাত্র তৃতীয় কীর্তি গড়েছেন সাকিব আল হাসান। ওয়ানডেতে অভিষেকে হ্যাটট্রিকের প্রথম কীর্তি তাইজুল ইসলামের। এই বছর দেখেছে দুজন তরুণ ক্রিকেটারের পরিণিতিপ্রাপ্তি আর ধারাবাহিকতা—অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ও স্টিভেন স্মিথ। ভারত সফরে খেলতে এসে বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিসংক্রান্ত বনিবনা না হওয়ায় মাঝপথেই দেশে ফিরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একসঙ্গে তিনটি বক্সিং ডে টেস্ট বছরটিতে দিয়েছে শেষ তুলির আঁচড়।
বছরের শেষ প্রহরে এসে স্মৃতিচারণার চেয়েও বেশি আঁকা হচ্ছে অবশ্য সম্ভাবনার ছবি। বাতাসে যে বিশ্বকাপের আগমনী সংগীত!