একের পর এক মামলার জালে আটকা পড়েছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার মামলার খড়গ ঝুলছে দলটির পাঁচ লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর ঘাড়ে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মামলা ও আসামির সংখ্যা বেড়েই চলেছে দিন দিন। শতাধিক মামলার আসামিও করা হয়েছে দলের অনেক নেতাকে। আগের পাঁচটিসহ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ মামলার আসামি। ইতিমধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। যে কোনো সময় তার ওপর গ্রেফতারের খড়গ নেমে আসতে পারে বলে বিএনপির আশঙ্কা। দুর্নীতির দুই মামলায় বিএনপি প্রধানের সাজা আতঙ্কও বিরাজ করছে দলে। সম্প্রতি খুলনার ফুলতলা উপজেলায় বাসে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা করেছে স্থানীয় থানা পুলিশ।
এ ছাড়া উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকা গ্যাটকোর পর নাইকো ও বড়পুকুরিয়া মামলা সচলের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত অন্তত ২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ৭৩টি মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে কারাগারে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ষষ্ঠবারের মতো জেল খাটছেন তিনি।বেগম জিয়া ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, জেল-জুলুম কিংবা মামলায় সাজার ভয় পান না তিনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ন্যায়বিচার পেলে এসব মামলা উচ্চ আদালতে টিকবে না বলেও তার বিশ্বাস। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, হাইকমান্ডসহ দলটির উল্লেখযোগ্য নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে অন্তত চার শতাধিক মামলা। জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রায় অর্ধশত মামলা। আসামিদের অনেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আবার নতুন মামলায় গ্রেফতারের আতঙ্কে গা-ঢাকা দিয়েছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। এসব মামলায় গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, জানমালের ক্ষতি, নাশকতার হুকুম দেওয়া, বেআইনিভাবে সংঘবদ্ধ হওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ, দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যাচেষ্টা, নাশকতা সৃষ্টি বা চেষ্টা, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেক মামলায় কিছু সংখ্যক আসামির নাম উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগই থাকে অজ্ঞাতনামা আসামি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার বিএনপি জোটের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নতুন নতুন মামলায় জড়াচ্ছে।’ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য ব্যারিস্টার এহসানুর রহমান জানান, বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের হওয়া মামলায় আসামিকে ন্যূনতম এক মাস থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়ার বিধান রয়েছে। সরকার একটি অসৎ উদ্দেশ্যে এসব মামলা দায়ের করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দলীয় সূত্র বলছে, মামলার ঘানি টানতে গিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে এখন। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নিঃস্ব প্রায়। আবার মামলার আসামি হলে দল থেকে কর্মীরা কোনো ধরনের সাপোর্ট বিশেষ করে আইনি সহায়তা পায় না বললেই চলে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি বলছে, হামলা-মামলা দিয়ে একটি দলকে স্তব্ধ করা যায় না। বিএনপির আইনজীবীরা দাবি করেন, সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচ লাখের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। মামলা-হামলার ভয়ে আতঙ্কিত কর্মীদের অনেকেই ঘরছাড়া।প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৪, খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪১, এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে ৯, আ স ম হান্নান শাহের বিরুদ্ধে ১১, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৫, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৭, যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ৯০, দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৪০, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহছানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ৩৬, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে অন্তত ১২০, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫ ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় দেশজুড়ে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, মো. শাহজাহান, রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিবুর রহমান হাবিব, শামীমুর রহমান শামীম, বেলাল আহমেদ, মনির আহমেদ, আবদুল মতিন প্রমুখ। বিএনপির আইনজীবীরা অভিযোগ করেন, নেতা-কর্র্মীদের দফায় দফায় রিমান্ডের নামে তাদের নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে। এ থেকে বাদ যাচ্ছেন না দলের সিনিয়র নেতারাও। সম্প্রতি কয়েক দফায় মির্জা ফখরুল, মো. শাহজাহান, রিজভী আহমেদসহ বেশ কয়েকজনকে রিমান্ডে নিয়ে এ ধরনের নির্যাতন চালানো হয়। এতে তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অতীতে কোনো সিনিয়র নেতাকে এভাবে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের নজির নেই বলেও দাবি করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন ও নস্যাৎ করার জন্য সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে নেতা-কর্মীদের একের পর এক মামলায় জড়াচ্ছে। সিনিয়র নেতাদেরও মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এটা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নামান্তর। এটি অগণতান্ত্রিক আচরণ। সরকারকে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ’ বিএনপির আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘সরকার রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা না করে প্রশাসন দিয়ে মোকাবিলা করছে। তাই বিএনপি নেতা-কর্মীদের নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এসব করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমানো যাবে না। – See more at: http://www.bd-pratidin.com/lead-news/2015/03/02/65893#sthash.Ivmn8kUQ.dpuf