২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই এক কালো অধ্যায়। কেবল বাংলাদেশের? পুরো ক্রিকেটের নয় কি? বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারির সূত্রপাত ওই দিনেই। আরও অনেকের মতো বিপিএল ফিক্সিংয়ের দায় চেপেছিল ইয়ান পন্টের কাঁধেও। ফিক্সিংয়ের দুর্নাম থাকায় চাকরি জোটেনি কোথাও। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) থেকেও এ ব্যাপারে কোনো সাড়া পাননি। অতঃপর মুখ খুললেন পন্ট। ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ‘ক্রিকইনফো’র কাছে সবিস্তারে বললেন বিপিএল ফিক্সিংয়ের নেপথ্যের ঘটনা।
তবে এ ঘটনায় নিজেকে নির্দোষই দাবি করেছেন পন্ট। তাঁর দাবি অনুযায়ী, ফিক্সিং নয়, বরং আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগকে (আকসু) সহযোগিতাই করেছিলেন তিনি। চিটাগাং কিংসের বিপক্ষে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের ম্যাচের ফিক্সিং মূলত তিনিই ফাঁস করে দিয়েছিলেন। আর তাতে উঠে এসেছিল মোহাম্মদ আশরাফুলসহ আরও অনেকের নাম।
ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের সাবেক এই কোচ বললেন, ‘শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ওই দিন জিসান চৌধুরীর (ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক) সঙ্গে আরেকজন লোক আমার কক্ষে এসেছিলেন। ওই সময় আমরা ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে জিতে বিপিএলের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে। জিসান আমাকে বলেছিলেন, আমরা চিটাগাং কিংসের বিপক্ষে ম্যাচটি ফিক্স করব। তিনি একটি কাগজও এনেছিলেন, যেখানে সব কিছু বিস্তারিত লেখা ছিল ম্যাচের কোন জায়গায় কী করতে হবে।’
পন্ট ঘাবড়েই গিয়েছিলেন সেদিন, “সঙ্গে সঙ্গে আমার উত্তর ছিল ‘আমি বাড়ি যাব’। আমার মাথা ঘুরছিল। তাঁরা নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজার জায়গায় অধিনায়ক ঠিক করেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুলকে। তাঁরা জানত, মাশরাফি এই কাজের সঙ্গে আসবে না, কারণ এর আগেই মাশরাফি ম্যানেজমেন্টকে জানিয়ে দিয়েছিল, এমনকি বিষয়টি মিডিয়াতেও এসেছিল। তাঁরা দলে নতুন দুই বোলারকে আনার কথাও বলেছিলেন, যারা সাহায্য করবেন তাঁদের। সঙ্গে তাঁদের পরিকল্পনায় ছিল একজন নতুন ব্যাটসম্যান আনার। আমি জানতাম তাঁরা ওয়াইস শাহকে চাইবে। ড্যারেন স্টিভেনস এতে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিল, আমাকে ম্যাচের আগেই বলেছিল, ও এসব কিছুই করতে চায়নি। সেদিন আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করে বললাম, বাড়ি চলে আসছি। এ নিয়ে দুজন আলাপ করি। সিদ্ধান্ত নিই, পরদিন সকালে বিষয়টি জানাব। তারপর টুর্নামেন্ট ছেড়ে চলে আসব। স্ত্রী আমার এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিল।’
পরদিন সকালেই পন্ট বিষয়টি জানিয়েছিলেন আকসুর কর্তা পিটার ও’শিকে। সব কিছু শুনে আকসুর কর্তা তাঁকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পন্টকে বললেন, পন্ট যদি সত্যিই সাহায্য করেন তাহলে ক্রিকেটকে ধ্বংস করার পেছনের লোকগুলোকে হাতেনাতে ধরতে পারবেন। পন্টও রাজি হয়ে থেকে যান বাংলাদেশে। এরপর আকসুর কর্তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হোটেলে পন্টের রুমে লাগানো হয় কলম আকারের ভিডিও ডিভাইস, সঙ্গে অডিও ডিভাইস লাগানো হয় ড্রয়ারের মধ্যে। পন্ট বলেন, ‘শিহাব চৌধুরী সব কিছু খুলে বললেন, এমনকি কোন কোন খেলোয়াড় জড়িত আছে তাদের নামও বললেন। তিনি মনে করছিলেন পাঁচজন খেলোয়াড় সাহায্য করবে তাঁকে। তিনি এটাও জানিয়েছেন, চিটাগং কিংস ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে কিছু জানে না। এর পর পিটার ও’শি এসে আমার রুম থেকে প্রমাণগুলো সংগ্রহ করেন।’
পন্ট এ পর্যায়ে উল্লেখ করেন বব উলমার প্রসঙ্গ। ২০০৭ সালে মারা যাওয়া সাবেক কোচ কী ধরনের বিপাকে পড়েছিলেন, সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘উলমারের কথা চিন্তা করি। তিনি জানতেন জ্যামাইকাতে সেদিন কী ঘটেছিল? ’ এ কারণে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন পন্ট, ‘…হ্যাঁ, আমি ভয় পেয়েছিলাম। তবে শেষমেশ পিটারের সঙ্গে কথা বললাম। ক্রিকেটকে বাঁচাতে বাংলাদেশে অবস্থান করে আরও কিছু দেখতে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।’
কীভাবে ফাঁদে পড়েছিলেন, পন্ট তাও বললেন, ‘ফিক্সিংয়ে জড়ানোর জন্য আমাকে টাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল। জিসান আমাকে ছয় হাজার মার্কিন ডলার দিতে চেয়েছিলেন। তবে আমি এটা চাইনি। তাঁকে কেবল বলেছিলাম, আমার বেতন চাই। তাঁকে বলেছিলাম, চুক্তির দ্বিতীয় কিস্তি দিতে। ১০ হাজার মার্কিন ডলার বাকি ছিল। সেটা পেলেই খুশি হতাম। তিনি বললেন, এ নিয়ে ভাববেন না। কদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। এরপর অডিও প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে জমা দিলাম। এটা পরিষ্কার, টুর্নামেন্ট শুরু আগে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আমি কেবল আমার বেতনই চেয়েছিলাম।’
পন্ট এও জানালেন, সে ম্যাচে দলের বাইরে রাখায় মাশরাফি বেজায় চটেছিলেন। সে প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমাকে একটা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, হাঁটুর চোটের কারণে মাশরাফি খেলবে না। সেটি অমূলকও নয়। কারণ, মাশরাফি বহুদিন হাঁটুর চোটে ভুগছিল। তবে যখন আমি তাঁকে বিষয়টি বললাম, তখনই ভীষণ চটে গেল। রেগেমেগে সামনে থাকা পানির বোতলে লাথি মারল। আমার ধারণা, সে বুঝতে পেরেছিল কী হতে যাচ্ছে।’
কিন্তু পন্ট ছয় হাজার ডলার পেয়েছিলেন। সে ব্যাপারে তাঁর দাবি, ‘দুদিন পর দলের খেলোয়াড় ও কোচদের খাম ভরে টাকা দেওয়া হলো। সেটা অপ্রত্যাশিতও ছিল না। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমাকে ১০ হাজার ডলার বেতন দেবে। কিন্তু খাম খুলে দেখি ৬ হাজার ডলার। আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। কারণ, এটা তো সেই পরিমাণ অর্থ, যেটা আমাকে বলা হয়েছিল ফিক্সিংয়ের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে পিটারকে জানালাম। তিনি বললেন, রেখে দেন। ওটা আপনার বেতনের টাকা। তাদের কাছে এখনো আপনার ৪ হাজার ডলার পাওনা। কিন্তু তারা বাকি ৪ হাজার ডলার আর দেয়নি।’ তথ্যসূত্র: ক্রিকইনফো।