নড়াইল প্রতিনিধি ঃ ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভায় কালনা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিলেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করার পর টানা ৫ বছর অবিবাহিত করলেও এখনও পর্যন্ত সেতুটি নির্মাণ করার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের পর ২য় দফায় সরকার গঠন করার পর নতুন সরকারের একনেক প্রথম সভায় ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ২৪৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে মধুমতি নদীর ওপর কালনা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। অনুমোদনের ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও চার লাইন (ফোর লেন) বিশিষ্ট কালনা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি আজও। মধুমতি কালনা ঘাটে সেতু হলে ঢাকার সাথে নড়াইলের দূরত্ব কমবে ১৫০ কিলোমিটার, বদলে যাবে খুলনা বিভাগের কৃষি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।প্রকল্পের সার সংক্ষেপ থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনে কাজ শেষ হবে। কালনা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬৮০ মিটার,প্রস্থ ১৮ দশমিক ২০ মিটার এবং ১০টি পিসি গার্ডার ও ০৩ টি বক্স গার্ডার।এছাড়া তিন দশমিক ৫০ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ ও ১২ দশমিক ৬৪ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কাজ রয়েছে। তবে প্রকল্পটি অনুমোদনের ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কাজই শুরু হয়নি। এমনকি সেতুর নকশাও হয়নি। তবে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেছেন মাত্র।এ ব্যাপারে উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী সংগঠন ‘স্বজন’ এর সদস্য ও সড়ক সেতু উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি নড়াইলের আহ্বায়ক শরীফ মুনীর হোসেন বলেন,কালনা সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন হওয়া সত্ত্বেও কাজ শুরু না হওয়া দুঃখজনক।নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, কালনাঘাটে দ্রুত সেতু নির্মাণ দরকার। সেতু হলে ঢাকার সাথে বেনাপোল স্থলবন্দর, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। এতে সময় ও জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে।তিনি আরো বলেন, কালনাঘাট দিয়ে বেনাপোল-ঢাকা সড়কের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার, যশোর-ঢাকা ১৬০ কিলোমিটার, নড়াইল-ঢাকা ১২৬ কিলোমিটার,খুলনা-ঢাকা ১৯৫ কিলোমিটার। অথচ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা যেতে এসব সড়কে ৩০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ব্যবসায়ী সুধীর বিশ্বাস বলেন, সেতুর অভাবে কালনা ফেরিঘাটে এসে আমাদের এক থেকে দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। মালামাল পরিবহনে সমস্যা হয়। যানবাহনের ব্যাপক চাপ থাকা সত্ত্বেও কখনও একটি আবার কখনও দু’টি ফেরিতে যানবাহন পারাপার করা হয়।কালনাঘাটের ফেরিচালক মফিজুর রহমান ও বুলু ঠাকুর জানান, কালনা ফেরিঘাট দিয়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ গাড়ি পারাপার হয়। গাড়ি পারাপারের নিবন্ধন খাতা থেকেও এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ফেরি বিকল হওয়ায় মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়তে হয়।ঢাকাগামী যাত্রীবাহী পরিবহন ও পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা জানান, কালনাঘাটে সেতু বাস্তবায়ন না হওয়ায় চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ফেরিতে বাস প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে এবং গাড়ির সারি (সিরিয়াল) থেকে ২০ ও বখশিশের নামে ১০ টাকা করে দিতে হয়।যদিও সরকারি নিয়মানুযায়ী বাস প্রতি ৫০ এবং ছোট বাস ও ছোট ট্রাক প্রতি ৩০ টাকা, মাইক্রোবাস প্রতি ২০ টাকা, জিপ, কার ও বেবি ট্যাক্সি প্রতি ১০ টাকা এবং ভ্যান ও মোটরসাইকেল প্রতি পাঁচ টাকা করে ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু সব ধরনের যানবাহন পারাপারে নির্ধারিত অঙ্কের দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। তাই সময়ের অপচয়রোধে এবং কালনা ঘাটের প্রতিবন্ধকতা দুর করতে ‘সেতু বাস্তবায়ন’ জরুরি হয়ে পড়েছে।নড়াইল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ জানান, কালনা ফেরিঘাটের পশ্চিম প্রান্তে নড়াইল এবং পূর্ব প্রান্তে গোপালগঞ্জ জেলা। মধুমতি নদী এই দু’টি জেলাকে বিভক্ত করেছে। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মধুমতি নদীর কালনা ঘাটটি গুরুত্বপূর্ণ হলে চরম অবহেলিত। দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়ন ও কৃষিপণ্যের রপ্তানিতে কালনা সেতু বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন।নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমান হতাশা ব্যক্ত করে বলেন,কালনা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে আমি সংসদে কথা বলব।সড়ক ও জনপথ গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সমীরন রায় জানান, কালনা সেতুর দরপত্র (টেন্ডার) এখনো হয়নি। নকশা (ডিজাইন) হাতে পাওয়ার পর দরপত্র হবে।১০-১২ দিন আগে জাপানের একটি টিম ঘাটটি পরিদর্শন করেছেন। তবে কবে থেকে কাজ শুরু হবে সেটা ঢাকা হেড অফিস বলতে পারবে। আমরা এ ব্যাপারে সঠিক কোন তথ্য দিতে পারবো না।উল্লেখ্য যে, গত ২০ জানুয়ারি যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কালনা ঘাট পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, এই সরকারের আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রথম কাজ কালনা সেতু নির্মাণ। কালনা সেতুর মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দর-যশোর-নড়াইল-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু-মাওয়া-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক যোগাযোগ’ স্থাপিত হবে।প্রকল্প এলাকাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।এছাড়া সেতু বাস্তবায়নে বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণে নড়াইলে একাধিকবার মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
নড়াইল প্রতিনিধি ঃহিমেল মোল্যা,