দিনের পর দিন ভরাট হচ্ছে তুরাগ। সুপ্রিমকোর্টের আদেশ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কোনো কিছুই আমলে নিচ্ছে না দখলবাজরা। নদের দু-পাড় দখল করে অবাধে ব্যবসা করছে বালু ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সরকারি পিলার (সীমানা স্তম্ভ) অতিক্রম করেই স্থাপনা গড়ে তুলছে হাউজিং কোম্পানি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব নিয়ে পরিবেশবাদীরা বারবার আন্দোলনে নামলেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না। অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কিছু সরকারি সংস্থার সহায়তায় এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অসাধু কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে এ অবৈধ দখল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বিরুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় তুরাগ ঘিরে অবাধে চলছে দখল বাণিজ্য। সেখানে গেলে তুরাগকে এখন আর কেউ নদ বলবে না। বরং সবার কাছে মনে হবে এটি একটি ছোট-খাট খাল। তাও আবার ঘোলা পানি। শুকিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা। সরকারি পিলার অতিক্রম করে নদের অর্ধেকটাই ভরাট করে ফেলেছে প্রভাবশালী দখলবাজরা। পাড় থেকে দেড়শ ফুটের মধ্যে কোনো জমি ব্যবহারের নিয়ম না থাকলেও নদ ভরাট করে অবাধে বাণিজ্য করছে বালু ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনই একটু একটু করে মিরপুরের দিয়াবাড়ী থেকে ধাউড় ব্রিজ হয়ে আশুলিয়া এবং কামারপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগের পাড় দখল করছে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বালু ব্যবসায়ীরা। সরকারি সীমানা অতিক্রম করে বিরুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন পশ্চিম পাশের একটি বড় অংশই অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে কয়েকটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। এছাড়া একই এলাকায় তামান্না পার্ক সংলগ্ন কয়েক একর জমি দখল হয়ে গেছে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে। টঙ্গীর আশপাশেও একই অবস্থা। টঙ্গী ব্রিজ এলাকায় চলছে দখলদারদের উৎসব। নদীর দখলদারিত্ব বন্ধে বেশ কিছু আইন থাকা সত্ত্বেও সেগুলো কোনো কাজেই আসছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাকের ডগায় থেকেই হাউজিং ব্যবসার নামে দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। নদের উপর এই আক্রমণ ঠেকাতে এবং নদের স্বাভাবিক প্রবাহকে রক্ষা করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই আদেশ দেন হাইকোর্টও। এছাড়া তুরাগ বাঁচাতে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৯ কোটি টাকা খরচ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
দায়িত্বপ্রাপ্তরা তুরাগ নদ রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষকে শোকজ করেন হাইকোর্ট। সেখানে নদের পাড় থেকে কেন বালু ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হবে না ব্যাখ্যা চেয়ে ১০ দিনের মধ্যে উত্তর দিতে বলা হয়। এরও আগে ২০০৯ সালে রাজধানীসহ আশপাশের চারটি নদী অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার করতে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। অথচ, এখনো পর্যন্ত উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সেই নির্দেশনা। এ ব্যাপারে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন, ‘নদীর পাড় থেকে অবৈধদের উচ্ছেদ করতে মহামান্য আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা পালন করা হবে।’ এতদিনেও সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সম্পন্ন হয়নি কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যেহেতু নতুন করে দখলের ঘটনা ঘটছে সুতরাং নতুন করে উচ্ছেদ করতেও সময় লাগছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অবৈধ বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা কয়েকটি সরকারি সংস্থার সঙ্গে আঁতাত করে নদের পাড়ের অবৈধ ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে। বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে দিনের পর দিন তুরাগকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে দখলদাররা তাদের পেশিশক্তির মাধ্যমে নদী দখল করে এক সময়ের স্বচ্ছ নির্মল পানির তুরাগকে একটি সংকীর্ণ খালে পরিণত করছে। জানা গেছে, তুরাগ কেবল রাজধানীর বড় বড় কয়েকটি নদীকেই সংযুক্ত করেনি এটি দূষিত বুড়িগঙ্গায় যমুনা নদীর স্বচ্ছ পানি সরবরাহে সাহায্য করছে। আর এভাবেই রাজধানীর পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রধানমন্ত্রী ও হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও তুরাগ নদ দখল অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাছের খান। তিনি বলেন, ‘দখলদাররা যে হাইকোর্টের নির্দেশনাও মানছে না, এটি একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।’