রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো তাদের মেয়াদি আমানতের সুদের হার আরেক দফা কমিয়েছে। ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদা পরিপত্র জারি করে জানিয়েছে, বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি আমানতের সুদের হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ (১০০ টাকায় ৫০ পয়সা) কমিয়েছে। আজ সোমবার থেকে নতুন এ সুদহার কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ মে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের এক সভায় আমানতের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপরেই ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদাভাবে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছে। ব্যাংকভেদে আমানতের নতুন সুদহার নেমে এসেছে সর্বনিম্ন সোয়া সাত থেকে সাড়ে সাত শতাংশে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বেসিক ব্যাংক নতুন এই সুদহার কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এ ধরনের উদ্যোগ বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে।
এর আগে গত মার্চে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বর্তমানের সমপরিমাণ (দশমিক ৫০ শতাংশ) কমিয়ে ব্যাংকভেদে সর্বনিম্ন পৌনে ৮ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। এর দুই মাসের মাথায় এসে তা আরও একদফা কমানো হলো।
নতুন সুদহার কার্যকর হওয়ার পর এসব ব্যাংকে কোনো গ্রাহক তিন মাসের জন্য ১০০ টাকা আমানত রাখলে তার বিপরীতে বছরে সর্বনিম্ন সোয়া সাত থেকে সাড়ে সাত টাকা সুদ পাবেন। আগে পেতেন ব্যাংকভেদে সর্বনিম্ন পৌনে আট থেকে আট টাকা পর্যন্ত।
মূলত ঋণের সুদহার কমাতেই এসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে এ থেকে সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ঋণের সুদহার ১০ শতাংশের নিচে নামবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমানতের সুদহারের পাশাপাশি যদি ঋণের সুদহারও কমানো না হয়, তাহলে খুব বেশি সুফল পাওয়া যাবে না। যদি ঋণের সুদ কমানো যায়, তাহলে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ অবশ্য ভিন্নমত দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মেয়াদি আমানতের সুদহার কমিয়ে কখনো ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালন খরচ কমানো, অপচয় রোধ, খেলাপি ঋণ আদায়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না। কিন্তু ঋণের সুদহারের কথা বলে আমানতের সুদহার কমানো হয়। আর তাতে সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিভিন্ন ধরনের আমানতের ওপর নির্ভর করেন, তাঁদের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে। আমানতকারীরা সংগঠিত নন বলেই সহজে ব্যাংকগুলো এ কাজটি করতে পারে।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে গত ২৩ মে পাঁচ ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার দেড় থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের পর রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার কমানোর এই সিদ্ধান্ত এল। এর ফলে ব্যাংকে আমানত রেখে সাধারণ মানুষের সুদ আয় আরও কমে যাচ্ছে।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তহবিল ব্যয় বা কস্ট অব ফান্ড ও ঋণের সুদহার কমাতেই আমানতের সুদহার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ঋণের সুদহার কবে থেকে ও কী পরিমাণ কমানোর হবে, তার সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। যদিও দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন।
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই গতকাল রোববার বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) নতুন সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেছেন, বর্তমান কমিটির প্রধান কাজই হবে ব্যাংকঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত মার্চের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আর ঋণের গড় সুদহার ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সোনালী ব্যাংক: সোনালী ব্যাংক তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের নতুন সুদহার নির্ধারণ করেছে সাড়ে সাত শতাংশ। ছয় থেকে এক বছর মেয়াদি আমানতে এ হার পৌনে আট এবং এক বছরের ঊর্ধ্বের মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে তা আট শতাংশ। সোনালী ব্যাংকে বর্তমানে গ্রাহকের আমানতের পরিমাণ প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা।
যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের সুদহার কমানোর উদ্দেশ্যে আমানতের সুদহার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আলাদাভাবে ঋণের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আরও জানান, আজ সোমবার থেকে নতুন সুদহার কার্যকর হলেও পুরোনো আমানতকারীদের সুদের হারে কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ ১ জুনের আগে যাঁরা ব্যাংকে আমানত রেখেছেন, তাঁরা আগের হারেই সুদ পাবেন।
অগ্রণী ব্যাংক: রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক গতকাল এক পরিপত্রে জানিয়েছে, ওই ব্যাংকের তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের নতুন সুদহার হবে সোয়া সাত শতাংশ বা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে এই সুদহার সাড়ে সাত এবং এক বছরের ঊর্ধ্বে মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে তা হবে ৮ শতাংশ।
তবে তিন ও ছয় মাস মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে কোনো গ্রাহক যদি পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানত জমা রাখেন, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ওই গ্রাহককে নির্ধারিত সুদের চেয়ে আরও দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বেশি দেওয়া যাবে।
জনতা ব্যাংক: জনতা ব্যাংক পরিপত্রে বলেছে, তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের নতুন সুদহার হবে সাড়ে সাত শতাংশ। ছয় থেকে এক বছর মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে তা পৌনে আট শতাংশ ও এক থেকে দুই বছর মেয়াদি আমানতে এ সুদ হার হবে ৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরই মধ্যে আমাদের ব্যাংকে ঋণের সুদহার কিছুটা কমানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা আরও কমিয়ে আনা হবে।’
ক্ষতির মুখে সাধারণ আমানতকারীরা: এদিকে, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষ সাধারণত সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে আমানত রেখে সুদ আয়ের মাধ্যমে আয়ের একটি বিকল্প উৎস তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রে অবসরভোগীসহ সাধারণ অনেক মানুষ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি আমানতের সুদহারের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্র ও আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সাধারণ এসব মানুষকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষের বিকল্প উৎসের আয় কিছুটা কমে গেলেও তাতে খুব বেশি দোষের কিছু দেখছেন না সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যেটি করেছে সেটি ঠিকই আছে। কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছিল। দিন শেষে যে ব্যয়ের চাপ সামলাতে হয় জনগণের করের টাকায়।
তাহলে সাধারণ মানুষের অল্প অল্প করে জমানো পুঁজি বা সঞ্চয় যাবে কোথায়—এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজ বলেন, বেশি মুনাফা যেখানে পাওয়া যাবে, আমানত ও সঞ্চয়পত্রে গচ্ছিত টাকার কিছু অংশ সেখানেই যাবে। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারও একটি বিকল্প সম্ভাবনার জায়গা হতে পারে।