পরীক্ষা শুরু বেলা ১১টায়। বৃষ্টির মধ্যে ছাতার নিচে মিরপুরের কাফরুল থানার বিপরীত রাস্তায় বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাতুল। বাড়তি ভাড়ায় রিকশা পেলেও একটু এগোতেই যানজট। হেঁটে রাতুল যখন বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌঁছাল, তখন তার জামাকাপড়-জুতা সবই ভেজা। স্কুলের সামনে কোমরপানি। সে অবস্থাতেই পরীক্ষা দিল রাতুল। প্রায় একই অবস্থা অন্য শিক্ষার্থীদেরও।
এখানেই শেষ নয়। ছেলেকে দিয়ে ফেরার পথে হারম্যান মাইনার স্কুলের কাছে খোঁড়া রাস্তায় পড়ে গেলেন রাতুলের বাবা নিরঞ্জন দেবনাথ। একজন দোকানি জানালেন, এর আগে আরও তিনজন সেখানে পড়ে আহত হয়েছে। এর মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার একটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সেখানে রাস্তা খোঁড়া হলেও পুরোপুরি মেরামত হয়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে মুষলধারার বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার কারণে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাকেই পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষজনের ভোগান্তি ছিল বেশি। অনেক এলাকার রাস্তায় হাঁটু থেকে কোমরপানি ছিল। যদিও বর্ষাকাল এখনো শুরু হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬৩ মিলিমিটার।
রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসার প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার ড্রেনেজ পাইপলাইন রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের রয়েছে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এর বাইরে দুই করপোরেশনের রয়েছে আরও আড়াই হাজার কিলোমিটার ভূ-উপরিস্থ (সারফেজ) ড্রেনেজ লাইন। ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ ডি এম কামরুল আলম চৌধুরী বলেন, ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা বর্তমান ড্রেনেজ-ব্যবস্থা ধারণ করতে পারে। কিন্তু গতকাল ধারণক্ষমতার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্ষা আসার আগেই ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করা হয়। এসব নর্দমা পরিষ্কার থাকলে জলাবদ্ধতা স্বল্পস্থায়ী হয়। তাঁর অভিযোগ, সিটি করপোরেশন তাদের নিজস্ব ড্রেনেজ লাইন ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব বেড়েছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. কুদরতউল্লাহ অবশ্য ভিন্ন কথা বললেন। তিনি দাবি করেন, ‘নিয়মিতই ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করা হয়। ওয়াসা নিজেদের লাইন পরিষ্কার করে না। ওয়াসা তাদের দোষ আমাদের ওপর চাপায়।’
আর জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের কাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকে দায়ী করেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আশিকুর রহমান। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি পক্ষকে দোষ দেওয়া ঠিক না।
ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্টে ১২ ফুট গভীরতার মধ্যে প্রায় ৮ ফুটই বর্তমানে বন্ধ হয়ে আছে। জলাবদ্ধতার এটিও একটি কারণ।
দুর্ভোগ: গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনে গিয়ে দেখা যায়, হাঁটুর ওপরে পানি। রিকশা উল্টে আহত হয় মৌচাকে একটি কোচিং সেন্টারের উদ্দেশে বের হওয়া শিক্ষার্থী অবন্তী ও তার বাবা। কামরুন্নেসা স্কুলের সামনে ছাড়াও অভয় দাস লেন থেকে সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ পর্যন্ত জলাবদ্ধতা দেখা যায়।
সকালে বৃষ্টি হলেও বেলা তিনটার সময়ও শান্তিনগর মোড়, সার্কিট হাউস রোড, রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সামনে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। মতিঝিলের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, শান্তিনগরে তাঁর বাসার সামনে বেলা ১১টার দিকেও কোমরসমান পানি ছিল।
মিরপুর ১৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা আবদুর রহমান বলেন, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাসা থেকে বেরিয়ে কারওয়ান বাজারে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য তিনি কোনো বাসই পাননি। মিরপুর গোলচত্বর পানিতে ডুবে যায়। পরে অনেক কষ্টে ভেঙে ভেঙে প্রায় দুই ঘণ্টায় কর্মস্থলে যেতে হয়।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত রাজধানীর মৌচাক, মালিবাগ, আরামবাগ, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশা, বংশালসহ পুরান ঢাকার অনেক এলাকা পানিতে সয়লাব ছিল। এ ছাড়া কে এম দাস লেন, অভয় দাস লেন, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, দিলকুশা, পুরানা পল্টন, কাকরাইল, মৌচাক, মালিবাগ, শেরেবাংলা নগর, রামপুরা, টঙ্গী ডাইভারশন রোড, পরীবাগ, মিরপুরের গোলচত্বর থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, শুক্রাবাদ, পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় গতকাল অস্থায়ী জলাবদ্ধতা হয়।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র যেমন দেখলেন: বর্ষাকাল আসেনি, কিন্তু ঢাকায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এ সমস্যা কমাতে চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি গতকাল বলেন, সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা পরস্পরকে দোষ দেওয়ার বিষয়টি অনেক পুরোনো। দুটির মধ্যে সমন্বয়ের জন্য তিনি উদ্যোগও নিচ্ছেন। মেয়র বলেন, বৈঠকে ঢাকা ওয়াসা তাঁকে জানিয়েছিল, বৃষ্টি হলে এক ঘণ্টার মধ্যে পানি সরে যায়; কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি দেখতে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেয়র শান্তিনগর এলাকায় যান। এ সময় তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিরা তাঁকে জানান, ভারী বৃষ্টি হলে সেখানে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা পর্যন্ত জলাবদ্ধতা থাকে। মেয়র ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ফোন করেন। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন প্রধান প্রকৌশলী। এ সময় তিনি মেয়রকে বলেন, গতকাল অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় পানি নামছে না।