সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠন করতে হবে।
একটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রায় দেন।
রায়ে আদালত আরও বলেছেন, কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে সরকারকে ওয়ার্ডভিত্তিক ভাড়া নিয়ন্ত্রক
নিয়োগ করতে হবে। ভাড়াটেদের সুরক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাড়িভাড়া সমস্যা সমাধানের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে এমন কয়েকটি সংগঠন আদালতের এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ সোসাইটির মহাসচিব কামরুদ্দিন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িভাড়া কমিশন গঠনের জন্য দাবি করে আসছিলাম। এ ছাড়া পেশাভিত্তিক লোকজনকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক করার দাবি জানিয়েছিলাম। হাইকোর্টের রায়ে এসব বিষয় উঠে এসেছে। রায়ে পুলিশকেও ভূমিকা রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করছি, এই রায় বাস্তবায়িত হলে বাড়িভাড়া নিয়ে দেশে যে অরাজকতা চলছে, তা বন্ধ হবে।’
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করার দাবিতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে এ রিট আবেদনটি করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতকাল রায় দিলেন আদালত। রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এ রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এর ফলে বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত বিরোধ ৮০ শতাংশ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’
রায়ের তিন নির্দেশনা: রায়ের প্রথম নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাড়িভাড়ার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে সাত সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করতে হবে। এর প্রধান হবেন আইন মন্ত্রণালয়-নির্ধারিত একজন আইনজ্ঞ। ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি গৃহায়ণ ও নগরবিশেষজ্ঞ, একজন অর্থনীতিবিদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, ভোক্তা অধিকার বা অন্য বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি, যিনি বাড়িভাড়া নিয়ে কাজ বা গবেষণা করেন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-নির্ধারিত একজন কর্মকর্তা।
রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, কমিশন সারা দেশের বাড়ির মালিক ও ভাড়াটে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। প্রয়োজনে গণশুনানির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি উভয়পক্ষের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের সুপারিশ করবে। কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে সরকার আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন, যাতে তাদের অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়।
দ্বিতীয় নির্দেশনায় আদালত বলেন, কমিশনের সুপারিশ প্রতিবেদন আকারে আসার আগ পর্যন্ত সরকার আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারা অনুসারে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ভাড়া নিয়ন্ত্রক (রেন্ট কন্ট্রোলার) নিয়োগের উদ্যোগ নেবে।
রায়ের তৃতীয় নির্দেশনা অনুসারে, কমিশনের সুপারিশ আসার আগ পর্যন্ত অবৈধভাবে ভাড়াটেদের গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইন বন্ধ বা জোর করে উচ্ছেদ বা অবৈধভাবে ভাড়া বাড়ানোর ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা ভাড়াটেদের সুরক্ষা দেবেন। এ ছাড়া কোনো পক্ষের কোনো অভিযোগ থাকলে তা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ওসিদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
রায়ের পর মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভাড়াটে ও বাড়ির মালিকদের মধ্যে বেশির ভাগ বিরোধের কারণ ভাড়া বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকা। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রসিদ, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াসহ বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ বাড়িওয়ালা আইন ভেঙে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান, যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন।
আন্দোলনকারীরা স্বাগত জানিয়েছেন: বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্টের কমিশন গঠনের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছে বাড়িভাড়া সমস্যার সমাধানের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করা কয়েকটি সংগঠন। এ নির্দেশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো। পাশাপাশি হাইকোর্টের এ রায়ে সাধারণ ভাড়াটেরাও আশান্বিত।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৩৫০ শতাংশেরও বেশি। আর ২০১৩ সালের চেয়ে ২০১৪ সালে ভাড়া বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। লাগামহীন এই ভাড়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। বাড়িওয়ালাদের ৮০ ভাগই বাড়িভাড়ার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ কারণে কোনো পণ্যের দাম সামান্য বাড়লেই বাড়িভাড়াও বাড়ানো হয়।
এমন পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য বাড়িভাড়ার সমস্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবছর বাড়িভাড়া বেড়েই চলেছে। ১৯৯১ সালের যে বাড়িভাড়া আইন আছে, সেটিও জটিল। এমন পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের রায় খুবই ইতিবাচক। এই রায় যদি বাস্তবায়িত হয় এবং ভাড়ার বিষয়ে তৃণমূল পর্যন্ত কথা বলার একটা সহজ নীতি করা যায়, তাহলে একটা বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
বেসরকারি সংস্থা নাগরিক সংহতির একটি জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীর নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ৫৭ শতাংশ মানুষকে আয়ের অর্ধেক খরচ করতে হচ্ছে বাড়িভাড়ার পেছনে।
ঢাকার কোন এলাকার বাড়িভাড়া কত হবে, সে জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের তালিকা আছে। কিন্তু কেউ সেটা মেনে চলে না। ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া আইন অনুযায়ী, নিয়ম না থাকলেও রাজধানীতে বছর বছর ভাড়া বাড়ানো হয়। আবার অনেক বাড়িওয়ালা ছয় মাস পরপর ভাড়া বাড়ান।