জ্বালানি তেল বিক্রি করে গেলো এক বছরে সরকারের লাভ হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও সরকার এ দাম সমন্বয় না করায় এ লাভ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না করলে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে’।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ কল্লোল মোস্তফা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন বিপিসির লোকসান হওয়ার কারনে এখন লাভ করতে হবে, এটি কোন যুক্তি হতে পারে না। কারন তেলের দামের প্রভাব সব পন্যের উপর পড়ে। এখন এই মুল্য সমন্বয় না করলে গার্মেন্টসহ সব ধরনের রপ্তানী পন্যের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই পরিমান লাভের টাকা আসলে কোথায় যাচ্ছে তা নজরদারিতে থাকা উচিত। কেননা পরে এই টাকা লুটপাট হলে তা হবে দু:খজনক।’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. হেলাল উদ্দিন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় না করা এক ধরনের অদক্ষতা।’ তিনি বলেন, এর ফলে তেলের যে ‘কাম্য ব্যবহার’ তা হচ্ছে না। ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। দাম সমন্বয় করলে এটি কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে করেন তিনি।
বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়’ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বরং গেলো ২১ জুলাই বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছিলেন, ‘তেলের দাম কমালে সাধারণ মানুষ সুবিধা না পাওয়ার আশঙ্কায় তা না কমিয়ে কৃষি জ্বালানিতে ভতুর্কি দিতে আগ্রহী সরকার।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ কল্লোল মোস্তফা প্রিয়. কমকে বলেন, ‘দাম কমালে সাধারণ মানুষ সুবিধা না পেলে ধরে নিতে হবে অর্থনীতির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন পন্যের দাম বাড়লে সরকার তা বাড়ানোর জন্য ‘পাগল’ হয়ে ওঠে। আর আর্ন্তজাতিক বাজারে কমলে স্বাভাবিকভাবেই তা কমানো উচিত।’
গেলো ফেব্রুয়ারি মাসে করা বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মূল্য সংযোজন কর ছাড়াই সরকার প্রতি লিটার অকটেন ও পেট্রোলে ৫ টাকা ৪৯ পয়সা মুনাফা করছে বিপিসি। কেরোসিনে এই মুনাফা ১৩ টাকা ৭৭ পয়সা, ডিজেলে ১৪ টাকা ৬৮ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা আর জেট ফুয়েলে ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা।
এর সঙ্গে সরকার কর হিসেবে আরো আদায় করছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অকটেন ও পেট্রলে সরকার প্রতি লিটারে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হিসাবে আদায় করছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা এবং বাকি ডিজেল থেকে শুরু করে বাকি পণ্যে প্রতি লিটারে কর নিচ্ছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা।
এছাড়াও আছে সরকারের লাভ হচ্ছে ভর্তুকি সাশ্রয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেলে সরকারের ভর্তুকি খাতের বরাদ্দ ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা।
সংবাদমাধ্যম সুত্রে জানা যাচ্ছে বিপিসি যে দরে আগামী ছয় মাসে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তাতেও অব্যাহত থাকবে লাভ। এমনকি এর পুর্ববর্তী ছয় মাসের চেয়ে এবারে কম মুল্যে এই চুক্তি করেছে তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে আগামী ছয় মাসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বর্তমান স্তরেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুতরাং আরো বেশি লাভের আশা থাকছেই।
আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণ বলছে, ‘যে রাজনৈতিক সমীকরণে এবারে তেলের দাম কমেছে তাতে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে আর তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই।’
এই প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যম সুত্রে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) একবছরে লাভ করেছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বিপিসি প্রতি লিটার অকটেন ও পেট্রোলে এখন লাভ করছে ৪০ টাকা আর ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে প্রতি লিটারে মুনাফা করছে ২০ টাকা পর্যন্ত। ভোক্তার পকেট কেটে এই পরিমাণ লাভ করছে সরকার।
সরকারের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে তেল বিক্রি করে বিপিসির দায় দেনা দাড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ঋণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, গেলো ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা হয়েছে ৩ হাজার ৪৫৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
বিপণন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান কারমুডির এক গবেষণায জানা যাচ্ছে ভোক্তা পর্যায়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ জ্বালানী তেলের দামের দেশ বাংলাদেশ। এ তালিকার শীর্ষ দেশ কঙ্গো, এর পরেই সেনেগাল।