সম্পাদনায়-সাইমুর রহমান, স্বদেশ নিউজ২৪.কম: দেশের প্রধান নগরী রাজধানী ঢাকার প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা দখল-দূষণে প্রায় শেষ। বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসন। পানি ও পয়োনিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। যেটুকু গড়ে উঠেছে, তারও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ অপ্রতুল। এসব তথ্য স্থানীয় সরকার ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া।
ঢাকায় যানজট প্রতিদিনের ঘটনা। খেলার মাঠ নেই এবং খোলা জায়গা নেই। ফুটপাতও দখলে। নেই কোনো প্রতিকার। নগর গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে ঢাকায় প্রতিবছর স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আসে অন্তত নতুন তিন লাখ মানুষ। এদের জন্য বাড়তি আবাসন, পানি, জ্বালানি, যাতায়াত, পরিবহন, পয়োনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা হয় না।
এসব কারণেই যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর জরিপে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে মহানগরী ঢাকার অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। এই ধারা চলতে থাকলে ঢাকা কি বাঁচবে? এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ কী?
সাধারণ মানুষের এসব জিজ্ঞাসা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকার প্রধান প্রধান প্রতিটি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) করা আছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই। এই যে বাস্তবায়ন নেই কিংবা কী পরিকল্পনা আছে, তার বাস্তবায়ন কীভাবে কতটা হচ্ছে, তা দেখারও কেউ নেই।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা বলেন, সরকার যে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করল, তাতে ১২টি জলাধার (রিটেনশন পন্ড) রাখার কথা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো দখল ও ভরাট করে ফেলা হয়েছে। নর্দমাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নেই। এগুলোর কার্যকারিতা কমে গেছে। দেখার কেউ থাকলে এ রকম হতে পারে না।
সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান ঢাকা মহানগরীর মধ্য দিয়ে একসময় প্রবহমান ছিল ৫৪টি খাল। এখন তার ১২টি কোনোমতে টিকে আছে। অন্যগুলো দখলদারদের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এভাবে পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা হলেও পরিকল্পিতভাবে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। বর্তমান ঢাকা মহানগরীর ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঢাকা ওয়াসার ‘স্টর্ম স্যুয়ারেজ’ আছে মাত্র ৩৬০ বর্গকিলোমিটার (২২ শতাংশ)। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোর মধ্যেও ময়লা জমে কার্যকারিতা কমে গেছে। এখন পানি সরবে কীভাবে?
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর (ওই সময় ঢাকার একাংশ ডুবে গিয়েছিল) দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় সরকার ‘ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করেছিল। এরপর ২০১০ সালে করা হয় ড্যাপ। এ দুটি পরিকল্পনাতেই ঢাকা মহানগরীতে ৫ হাজার ৪২৩ একর জায়গা রাখার কথা বলা হয়েছে জলাধার হিসেবে। খাল-নদী রাখার কথা ২০ হাজার ৯৩ একর। বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল সংরক্ষণ করার কথা ৭৪ হাজার ৫৯৮ একর। অন্তত কোটি মানুষের এই নগরীকে এগুলো ছাড়া বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু এর প্রায় সবই দখল হয়ে গেছে।
ঢাকায় মানুষ ও যানবাহনের তুলনায় রাস্তাঘাট কম। সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ লোক আসছে। ঢাকায় রাস্তা, ফুটপাত দখল হয়ে যায়। এখানে সাধারণের জন্য খেলার মাঠ তো নেই-ই, একটি নগরে ন্যূনতম যেটুকু খোলা জায়গা থাকা দরকার, তা-ও নেই। খেলার মাঠ, খোলা জায়গা কোথাও রাখা হলেও তা চোখের সামনে দখল হয়ে যায়। নগর কর্তৃপক্ষ বা সরকার তা রোধ করতে পারে না।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় চার দশক ধরে পরিকল্পনা উপেক্ষা করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীকে অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে ফেলা হয়েছে। এ দুটি নগরীতে সার্বিকভাবে সুশাসন ও সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকট। এ অবস্থা থেকে নগর দুটিকে রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় (প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিপরিষদ) থেকে বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, নগরীর সমস্যা নিয়ে গণমাধ্যম ও পেশাজীবীরা যথেষ্ট সোচ্চার। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে সমস্যার সমাধান হবে না।
এই নগরীতে নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। যুগ যুগ ধরে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তুলে সরবরাহ করায় ভূগর্ভের পানির স্তরও প্রতিবছর নেমে যাচ্ছে। নগরীর একাধিক এলাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে সেখানে আর কোনো গভীর নলকূপ বসানো যাবে না। তাই ঢাকার মানুষ বাঁচাতে এখন পাইপলাইন করে পদ্মা-যমুনা থেকে পানি আনার পরিকল্পনা করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
প্রতিদিন কর্মস্থলে যান, এমন কয়েকজন প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকায় দৈনন্দিন স্বাভাবিক চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রাস্তায় বের হলেই যানজট। অথচ গণপরিবহনের ব্যবস্থা বলতে গেলে একেবারে নেই। তাঁদের এই অভিজ্ঞতার বাইরেও এই নগরীতে বায়ু ও পানিদূষণের পরিস্থিতি ভয়াবহ। আছে মাটি, শব্দ ও দৃষ্টিদূষণও। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলেও তাঁদের ক্ষমতা সীমিত। নগরীর উন্নয়ন কার্যক্রমে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত মিলে ৫৪টি সংস্থা কর্মরত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট।
এ অবস্থা থেকে বের করে এনে ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য করণীয় জানতে চাইলে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, প্রায় সব সমস্যাই মানুষের সৃষ্টি। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। কাজেই সমাধানের জন্যও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের সম্পৃক্ততা দরকার হবে।
তিনি বলেন, ঢাকার সমস্যাগুলো সমাধানে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীকে সম্পৃক্ত করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ শুরু করা দরকার।
Ref-প্রথমআলো